#ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
#পর্বঃ২
#লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন
_____________________________
স্টেজ ছেড়ে আসার পর নোরিনকে হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। নোরিন কারো কথার কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের জন্য বরাদ্দ করা রুমে চলে এলো। ব্যাটা বজ্জাত! বাবার সাথে মিলে ঐ অশান্ত ছেলেটাকে ইচ্ছে মতো গালি দিতে ইচ্ছে করছে। কারো উপর মন বেজার হলে, নোরিন আর তার বাবা দুজনে মিলে একসাথে গালি দেয়। এতে তারা দুজনেই শান্তি পায়।
নোরিন কি মনে করে ফোন আর দিলো না বাবাকে। গোসল করে খানিকক্ষণ বাদেই টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বের হলো বাথরুম থেকে। হঠাৎ মনে হলো দরজায় ক্রমাগত কেউ নক করছে। নোরিন স্বাভাবিক পা ফেলে দরজা খুললো। মকবুল দাঁড়িয়ে আছে। মকবুল ছোটবেলা থেকেই তুতলায়। নোরিনকে বললো,
---- আ-আ-ফা আপনাকে ম-মা-মী ডাকতাছে...
মকবুল ঠোঁট বামদিকে কাত করে অতিকষ্টে বলা শেষ করলো। নোরিন মাথা নাড়িয়ে দরজা বন্ধ করে ফেললো।
মকবুল দরজা বন্ধ করার পরেও দাঁড়িয়ে আছে। এই মেয়েটাকে প্রচন্ডরকম ভয় পায় সে। সে তো মামীমাকেও এতো ভয় পায় না। এইতো সেইদিন, মামীমা তাকে ক্ষ্যাতে গিয়ে একটা কচি লাউ তুলে আনতে বলেছিলো। কিন্তু সে লাউ না এনে "ভালোবাসা কারে কই" ছবি দেখতে চলে যায়। উফফ শাবনূর-রিয়াজের কি মাখোমাখো প্রেম! মকবুল বাড়ি ফেরে রাতে। মামীমা বকা দিলেও গায়ে মাখেনি। কাউকে ভয় পায় নাকি সে!!!
বাইরে শোরগোল শোনা যাচ্ছে এখনো। মকবুল জানিয়েছে আজ সারারাত ধরে গান চলবে। শিল্পী ভাড়া করে এনেছে শহর থেকে। বাড়িতে কেউ নেই বললেই চলে। সবাই গানের ওখানে। নোরিন জিন্স আর অফশোল্ডার টপ পরে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিলো। মাথায় একটা কমলা রঙের মানকি টুপি। হালকা শীত পরেছে। নানুমণির রুম হালকা ভেজানো। দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো কেউ আছে কিনা। পানের বাটা সামনে নিয়ে নানু একধ্যানে পান চিবুচ্ছে। ঠোঁটদুটো একেবারে টকটকে লাল হয়ে গেছে। নোরিন একটু শব্দ করলো,
--- নানুমণি আসবো?
---- সুন্দরী বানু তুমি আইছো? বুড়িটারে তো ভুলে গেছিস একেবারে।
নোরিন মিষ্টি করে হেসে তার নানুরে জড়িয়ে ধরলো। নানু এবার কান্নাভেজা কণ্ঠে বললেন,
--- মাঝেমধ্যে আসিস নানুভাই। তোরে দেখলে তোর মায়ের অভাব পূরণ হয়। আজ এমন একটা খুশির দিনে আমার মাইয়াটা আল্লাহর কাছে....
নোরিন চুপ করে আছে৷ বিরক্ত লাগছে তার। এসব কথা শুনলে তার রাগ লাগে। নিজেকে অসহায় মনে করতে চায়না সে।
---- নানুভাই মাথায় কি দিছো তুমি? এখন তো পুতুলের লাখান লাগতাছে তোমারে। ঘরে বইসা রইছো ক্যান? যাও বাইরে গিয়া সবার সাথে মজা করো।
নোরিন কথা বাড়ালো না। গায়ের চাদরের উপর একটা জিন্সের জ্যাকেট পরে বাইরে বেরিয়ে এলো। নানুমণির বয়স হয়েছে। কথার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। সাধু- আঞ্চলিক মিশিয়ে তিনি নাতিদের সাথে কথা বলেন।
উঠানের মাঝখানে চেয়ার টেনে সবাই গোল হয়ে বসে আছে। স্টেজে গানের দলের প্রস্তুতি চলছে। জায়ান ভাইয়াকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। নারকেল গাছের গুঁড়িতে বসে জেরু আর কিছু সমবয়সী কাজিন বসে আছে। নোরিন তাদের পাশে গিয়ে বসতেই,
জেরুঃ এই এটা কে? নোরিন তুই!!! চেন্জ করে ফেললি কেনো?
সাইমাঃ নোরিন তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। তোমাকে না আমার বলিউডের আলিয়া ভাটের মতো লাগে। হাসলেই টোল পড়ে। তুমি তো হাসোই না। গায়ের রংও সেইম।
নোরিন মনে মনে আবার বিরক্ত হলো। কারো সাথে তুলনা করলে, তার রাগ হয়। কেনো অন্যের মতো হতে হবে? সে নিজে কি কারো আইডল হতে পারে না? হবে। যেদিন সবাই তাকে আর্মি অফিসার নোরিন আলী সেরনিয়াবাত হিসেবে চিনবে, সেদিন অনেকেই আইডল মানবে।
রাইদাঃ ঐ আজকে না একজনের উপরে ক্রাশ খাইছি।
নোরিন আড়চোখে তাকালো।
জেরুঃ আমিও খাইছি ভাই। বিয়েবাড়ি মানেই হলো ক্রাশ খাওয়ার জায়গা। ক্রাশ খাইতে পয়সা লাগে না। বুঝছিস?
হঠাৎ একটা ছেলে নারকেল গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে "জেরু,জেরু" বলে ডাকতে লাগলো। জেরু ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে বললো,
---- কিরে মতিন? ব্যাপার কি?
মতিন কিছু না বলে একটা কাগজ ছুঁড়ে মারলো। জেরু কাগজটা খুলে দেখলো একটা নাম্বার দেওয়া আছে। জেরু ভ্রু কুঁচকে মতিনের দিকে তাকাতেই, মতিন নোরিনের দিকে ইশারা করলো। জেরু একগাল হেসে নোরিনকে নাম্বারটা দিলো। নাম্বারটা দিতেই নোরিনের মুখে হাসি খেলে গেলো। মতিনকে ডাকলো সে,
--- মতি ভাই, এদিকে আসেন।
মতি একটা ঢোক গিলে নারিকেল গাছের পেছন থেকে হাত কাচুমাচু করে সামনে এসে দাঁড়ালো। নোরিন দাঁড়িয়ে মতিনের কাঁধে হাত দিয়ে চাপড়ে বললো,
--- আমার সাথে প্রেম করবা?
মতিন বারবার ঢোক গিলছে। কি সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা! জেরুরা সবাই মুখ টিপে হাসছে।
--- দেখি নিউনের তৃতীয় সূত্রটা একটু বলো। তারপর বলবা, তোমার নানির দাদীর নাম কি? শেষ প্রশ্ন, দাঁতের রং সাদা কেনো, কালো হলে কি সমস্যা হতো? সব প্রশ্নের উপর পারলে তুমি চাকরি পেয়ে যাবে নিশ্চিত।
মতিনের পস্রাবের বেগ এসেছে। হাঁটু কাঁপছে তার। চোখমুখ শুকিয়ে কাঠ। যেন এইমাত্র বরফগলা পানিতে ডুব দিয়ে এসেছে। নোরিন কাঁধের উপর থেকে হাতটা সরাতেই মতিন ভোঁ দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেলো। দোয়া দরুদ পড়ে নিজের উপর ফুঁ দিচ্ছে সে।
নোরিন হাসছে। খিলখিল করে হাসছে। মানুষের সাথে এমন করতে তার ভীষণ মজা লাগে। জেরুরাও তার সাথে তাল মিলিয়ে হাসলো অনেকক্ষণ।
আচমকা সাদা পাঞ্জাবিওয়ালা মানে নিবিড় নামের অশান্ত ছেলেটা নোরিনদের সামনে এসে দাঁড়ালো। নোরিনরা তখনো হাসছিলো। নিবিড়কে দেখে নোরিনের হাসি থেমে গিয়ে বুকটা আবার লাফাতে শুরু করলো। জ্যাকেটাকে খামচে ধরে সাথেসাথে পেছনে ফিরে গেলো সে। বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে আবার সামনে ফিরলো।
নিবিড়ের হাতে একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,
--- হেই গার্লস! সবাই পোজ নিয়ে দাঁড়াও। তোমাদের ছবি তুলব। ট্রেডিশনাল থিং, ভেরি সুইট...
নোরিনের হাত পা এখনো কাঁপছে। নিবিড় ক্যামেরায় চোখ রেখে কি যেন করছে। আর জেরু, মিমহা, রাইদারা একে অপরের কোমরে হাত রেখে সুন্দরমতো পোজ নিয়ে দাঁড়ালো। নোরিনের উত্তেজনায় হাতপা কাপছে। চোখের পলক ফেলছে বারবার। সে কি ছবি তুলবে? জেরুদের সাথে দাঁড়াবে? নোরিন একধরনের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে জেরুদের পাশে দাঁড়ালো। নিবিড় ক্লিক করতে গিয়েও করলো না। ক্যামরাটা নিচে নামিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
---- এক্সকিউজ মি?
নোরিনকে উদ্দেশ্য করে বলায় নোরিনের ভুরুও কুঁচকে গেলো আপনাআপনি।
--- জ্বি?
--- আমি তো তোমাকে বলিনি। রাইদা'দের বলেছি। বাই দ্যা ওয়ে, হু আর ইউ।
নোরিনের বিস্ময়মাখা কণ্ঠে বললো,
--- মানে?
নিবিড় স্বাভাবিক গলায় নেমে যাওয়া পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে বললো,
---- আমি তো শাড়ি পরা মেয়েদের ছবি তুলবো বলেছি। যেটা আমাদের কালচার। ওয়েস্টার্ন এসব ড্রেস আজকাল উঠতে বসতে দেখা যায়।
মুহূর্তেই নোরিনের চেহারা পাল্টে গেলো। এতোবড় অপমান? নোরিন সেরনিয়াবাতকে রিফিউজ করে? এতো বড় ক্ষমতা!!! নোরিন অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে মানকি টুপিটা খুলে লক্ষহীনভাবে ছুঁড়ে মারলো।
নোরিন কি রাগ দেখাবে? তার আগেই নিবিড় হাত দোলাতে দোলাতে চলে গেলো। কিছু করতে না পেরে নোরিন ধপ করে বসে পরলো মাটিতে। ঠোঁট চেপে একদৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে।
জেরু স্বান্তনার সুরে বললো,
--- নোরিন কিছু মনে করিস না ভাই। নিবিড় ভাইয়া এমনই।
--- ছেলেটা কে?
---- ওহ তুই তো চেনার কথা না। আমি বলছি, উনি হচ্ছেন বড় নানুর ছেলের ছেলে। উনারা তো ঢাকায় থাকতেন। নানুর অমতে বিয়ে করায় এখানে কোনোদিন আসেনও নি। এসব আমাদের জন্মের আগের কথা। জায়িন ভাইয়ার বিয়েতে নানুমণি উনাদের দাওয়াত করেছেন। বড়নানুও তো মারা গেছে সেই কবে। দ্বন্দ রেখে কি লাভ বল! জানিস? নিবিড় ভাইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ভবিষ্যৎ কম্পিউটার ইন্জিনিয়ার।
নোরিন পুরো ব্যাপারটা ভাবলো, তার মৃত নানাভাই টানা তিনবারের চেয়ারম্যান ছিলেন এলাকার। তিনি জীবনে দুটি বিয়ে করেছেন। নোরিন ছোটনানুর নাতি। আর নিবিড় বড় নানুর ছেলের ছেলে। ইট মিনস্, নিবিড় নোরিনের সৎ মামাতো ভাই। ব্যাপারটা ভাবতেই নোরিনের মুখ বিস্ময়ে খেলে গেলো। নিজের মনে আবার আওড়ালো,
---- সৎ মামাতো ভাই.... ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ওহ মাই গড!
নোরিনের মনে পড়ে না তার নানুবাড়ির কোনো আত্মীয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে কিনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানেই তো হাজারো শিক্ষার্থীর কাছে স্বপ্ন। সারা দেশের স্টুডেন্ট ওখানে পড়ার জন্য পাগল। এতো ক্যান্ডিডেট ওখানে!!! আর এই নিবিড় নামের অশান্ত , অসভ্য ছেলেটা ওখানে টিকলো কীভাবে? নোরিনের নিজেকে এবার বোকা মনে হচ্ছে। ধ্যাত এসব কি ভাবছে সে। পরক্ষনেই নিজেকে এটা বলে স্বান্তনা দিলো এই বলে যে, নোরিনের এই ভার্সিটির উপর দুর্বলতা আছে তাই ভাবছে। কিন্তু যাই হোক না কেন এই নিবিড়কে সে ছাড়বে না। এই অপমানের যোগ্য জবাব সে দেবেই দেবে।
#চলবে