#ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
#পর্বঃ০৩
#লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন
_________________________________
রাত বাড়ছে। নিস্তব্ধ কুটিল রাত। বাড়ির পেছনের বাঁশঝাড় থেকে জংলী শেয়ালের হাঁক ভেসে আসছে। ঘোর অমাবস্যায় চাঁদটাও কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। যেন অমাবস্যায় তার ভীষণ ভয়৷
কাঠের প্রকান্ড দোতলা বাড়ির কোনো এক রুমে নোরিন পড়ছে। বিরবির করে পড়ছে। গায়ে হলুদের সমস্ত ফাংশান শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। পুরো বাড়ি এখন গভীর ঘুমে নিদ্রাচ্ছন্ন। চার্জলাইটের আলোটা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের পাতার উপর পরেছে। আলো জ্বালায়নি, পাছে কেউ জেনে যাবে যে, ও এতো রাত অব্ধি জেগে আছে। রুটিন অনুযায়ী ফিজিক্সের এক অধ্যায়ের সমস্ত নৈর্ব্যক্তিকের জন্য বরাদ্দকৃত সময় একসপ্তাহ। আজকেই শেষ দিন অথচ এখনো বেশ কয়েকটা পাঠ ছোঁয়াও হয়নি। যেভাবেই হোক রাতের মধ্যেই শেষ করতে হবে। বাস্তবিক জীবনে না হোক, পড়াশোনায় নিজেকে মোটেও আনস্মার্ট প্রমাণ করতে চায়না নোরিন।
দরজায় টকঠক আওয়াজ হচ্ছে। নোরিনের মনোযোগ বিঘ্নিত হলো। বিরক্তি এড়িয়ে পড়তে শুরু করলো আবার। ঠকঠক করতে করতে একেবারে প্রাণ চলে যাক, তবুও সে দরজা খুলবে না। এদিকে দরজায় ক্রমাগত কেউ বারি মেরেই চলেছে। নোরিন সশব্দে বইটা ঠাস করে বন্ধ করলো। গলার মাফলারটা টিকমতো পেঁচিয়ে কপাল কুঁচকে দরজা সামান্য খুলে উঁকি দিলো কে আছে দেখার জন্য। নোরিন মাত্রই দরজার ছিটকিনিটা খুলছিলো। পুরোটা আর খুলতে হলো না। অমনি অপরপাশে থাকা ব্যক্তি ধাক্কা মেরে পুরো দরজাটা হা করে মেলে দিলো। নোরিন 'আহ্' শব্দ করে দূরে ছিটকে পরলো। চোখ বন্ধ করে কপাল ডলছে সে। এভাবে কেউ ধাক্কা মারে? নোরিন আদোআদো চোখে দেখলো, একটা লম্বা লোক হুড়মুড় করে আর বিছানায় শুয়ে পরছে। নোরিন ঘটনার আকস্মিকতায় প্রায় চেঁচিয়ে বললো,
---- একি, আপনি কে? আমার রুমে এসে বিছানায় শুয়ে পরলেন যে? নানুমণিকে ডাকবো? নানুমণি....... এই নানু...!!! দেখো চোর বেডে উঠে গেছে.... নান...
আর বলতে হলো না নোরিনকে। বিছানায় শুয়ে থাকা ব্যক্তি উঠে এসে তার মুখ চেপে ধরেছে। নোরিন গোঁ গোঁ আওয়াজ করছে। আলোর অভাবে লোকটার মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। চার্জলাইটটাও টেবিলের উপর৷ তারউপর লোকটার কড়া পারফিউমের গন্ধে নোরিনের গা গোলাতে শুরু করেছে। লোকটা ফিসফিস আওয়াজ করল,
---- এই পিচ্চি চুপ!!! আমি কোনো খারাপ মতলবে আসিনি। তুই তো আমার ফুপ্পির মেয়ে। সো, তোর রুমে আসাই যায়।
নোরিন শান্ত হতেই লোকটা তাকে ছেড়ে দিলো। নোরিন অস্ফুটে বললো,
--- নিবিড়....
---- এই নিবিড় কি রে? ভাইয়া ডাকবি আমাকে।
---- নিবিড় ভাইয়া তুমি?
--- বেয়াদব তুমি কি? আপনি বল। বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানিস না?
নোরিন আপাতত অবাকের শেষপ্রান্তে আছে। তার মনে হচ্ছে, সে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে। সামনে থাকা ব্যক্তি অর্থাৎ নিবিড় তার সাথে এভাবে কথা বলার কারণ সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। তখন তো জেরুদের সামনে অপমান করেছে আর এখন সরাসরি 'বেয়াদব' সম্বোধন পেলো!! নোরিন নাকে ফোঁসফোঁস নিশ্বাস ছাড়ছে। বজ্জাত ছেলে! দেখে মনে হয়না এতো খারাপ ব্যবহার। সমস্যা হলো নোরিনের মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। গলা কাঁপছে। হার্ট ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছে। সে মনে মনে ভাবলো,
--- এই ছেলের সামনে আমি নিজের ব্যক্তিত্ব হারাচ্ছি। নো নোরিন নো! তুই যে এই ছেলের উপর দুর্বল কিছুতেই বুঝতে দিবি না। তুই জানিস না? এইরকম ছেলেরা তোর আগেপিছে ঘুরঘুর করে? নিজের ফর্মে চলে আয়৷ বিহেভ ইউরসেল্ফ।
নোরিন শক্ত গলায় নিজেকে ধাতস্থ করে নিবিড়কে বেরিয়ে যেতে বলবে, তার আগেই নিবিড় বালিশের উপর মাথা রেখে বললো,
---- শোন, রাইদার কাছে জেনেছি তুই আমার ফুফাতো বোন হোস। সো, ঘরের মানুষ যখন এতো ফর্মালিটির দরকার নেই। আমরা আমরাই তো, তাইনা? একটা রুমও খালি নেই। আমি না ভীড় করা রুমে ঘুমাতে পারিনা৷ শুনেছি তোর রুমটা খালি। আমি এখন ঘুমাবো। একটা কথাও বলবি না। ওকে? গুড নাইট।
নোরিন দাঁতে দাঁত চেপে সবটা হজম করলো। নিজের উপর রাগ লাগছে। কিছুই তো বলতে পারছে না। কিছু বলতে গেলেই এই বজ্জাতটা মুখের উপর কথা শোনাচ্ছে। চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি চিনে, তার মধ্যেই এহেনো ব্যবহার! বলে কিনা বেয়াদব!!!
অতিরিক্ত অপমানবোধে নোরিন আর নিবিড়কে ডাকলো না। ইচ্ছে হলো না ডাকার। সে বর্তমান পরিস্থিতিটাকে মেনে নিলো। হাট করে খোলা দরজাটা বন্ধ করলো ক্ষীণ আওয়াজে। বাইরের কেউ দেখলে কানাঘুষা শুরু হবে। যেচে বদনাম আনার ইচ্ছে নেই তার।
নোরিন গলা ভিজিয়ে আবার পড়তে বসলো। একধ্যানে সূত্র প্রয়োগ করে ম্যাথ সল্ভ করছে তো, আবার গুণগুণ করে সংজ্ঞা মুখস্থ করছে।
---- যদি বল প্রয়োগের ফলে বলের প্রয়োগ বিন্দু বলের বিপরীতে সরে যায় বা বলের বিপরীত দিকে সরণের উপাংশ....
----- এই বেআক্কল!! এতো জোরে জোরে পড়ছিস কেনো? আমি ঘুমাচ্ছি দেখছিস না? দিলি তো ঘুমটা ভাঙিয়ে?
---- ভাইয়া আমি পড়ছিলাম....
---- আবার বেআক্কলের মতো কথা বলিস! এই তোর কি বিন্দুমাত্র মেনার্স নেই? বুঝেছি আমাকেই ঠিক করতে হবে। মুখে মুখে কথা বললে এবার থেকে কানের নিচে একটা করে পরবে।
লজ্জায়, অপমানে নোরিনের ফর্সা গালদুটো টকটকে লাল হয়ে এলো। সে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না। তার মনে হলো গলাটা কেউ খিঁচে চেপে ধরে আছে। নোরিন উপলব্ধি করলো, সে নিবিড়ের কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছে। বারবার বোকা বনে যাচ্ছে সে। আরো উপলব্ধি করলো,
----- ছেলেটা চরম অসভ্য এবং বজ্জাত। আদর্শ উদ্ভিদকোষ পেঁয়াজকে যখন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রাখলে ছোট ছোট লক্ষ লক্ষ কোষ দেখা যায়, তেমনি এই নিবিড় নামক অশান্ত ছেলেটাকেও অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রাখলে প্রমাণিত হবেন,সে একজন আদর্শমানের উৎকৃষ্ট বজ্জাত ছেলে।
রাতটা নোরিন চেয়ারে বসে বসেই কাটিয়ে দিলো। আর নিবিড় বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। ভোর হতেই নিবিড় নিজের রুমে চলে এলো। আর এদিকে নোরিনের ঘুম ভাঙতেই দেখতে পায়, নিবিড় নেই। চলে গেছে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই পারফিউমের গন্ধটা তীব্রভাবে নাকে এসে লাগলো৷ নোরিন ধরফর করে দাঁড়িয়ে গেলো। কাপড় শুঁকে দেখলো, তার পুরো গা ঐ বজ্জাতের পারফিউমের গন্ধে মাখামাখি। একটা কুৎসিত গালি দিলো আবার নিবিড়কে।
সকালে নাস্তা করতে গিয়েই আরেক বিপত্তি। রান্নাঘরে হৈ-হুল্লোড় লেগে আছে। যে যেখানে পারছে বসে খাচ্ছে। নোরিন কোনোমতে মামীর কাছ থেকে গরুর মাংস,রুটি আর একগ্লাস পানি নিয়ে লেপের উপর কায়দা করে বসলো। এদিকে ভীড় কম।
এদিকে নোরিনের দেখাদেখি অন্যান্য কাজিনরাও তার পাশে গোল করে বসলো। নোরিন বিরক্ত হলেও কিছু বললো না। হৈ-হুল্লোড় বেড়ে গেছে। হঠাৎ নোরিনের মাথায় একটা চাটি মেরে নিবিড় আয়েশ করে তার পাশে বসলো। জেরু ছিলো নোরিনের পাশে। সে একটু সরে নিবিড়কে বসার জায়গা করে দিলো। নোরিন পানির গ্লাসটা তুলে খেতে যাবে তার আগেই, নিবিড় গ্লাসটা কেড়ে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো গ্লাস খালি করে ফেললো৷ নোরিন রাগে কিড়মিড় করে ঘর কাঁপানো চিৎকার দিয়ে বললো,
---- এই আপনি বারবার আমার পানি খেয়ে ফেলেন কেনো?
উপস্থিত সবাই হতভম্ব। বলে কি মেয়ে....
#চলবে
( আসসালামু আলাইকুম। বিয়ে বাড়ির উপরেই বেশ কয়েক পর্ব চলবে। ঘটনা মূলত এখান থেকেই শুরু। আশা করি বুঝতে পেরেছেন। ধন্যবাদ।)