#ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
#পর্বঃ১৯
#লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন
রাত বাড়ছে। গভীর তন্দ্রাচ্ছন্ন সবাই। রাতের সাথে তাল মিলিয়ে বাইরে বৃষ্টির বেগও বাড়ছে যেন। নোরিনের দৃষ্টি জানালা ভেদ করে বাইরে নিবন্ধ। দৃষ্টি সেদিকে থাকলেও মন অন্য অভিসারীতে। চোখেও বর্ষণের ছোঁয়া। সবকিছু ছেড়ে ছোড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে তার৷ ফর্সা গালে লাল আভা সৃষ্টি হয়েছে। কান্নার তোড়ে গলার খাদে গর্ত সৃষ্টি হয়ে আবার পরিপূর্ণ। চোখের বড় বড় পাপড়ি পানির ছোঁয়াতে একজোট হয়ে হয়ে যেন বলছে, 'কান্না থামাও নোরিন। কান্নাতে তোমায় না। ভুলে যাও তাকে। ছুঁড়ে ফেলে দাও। অতীত নিয়ে বাঁচতে গেলে সামনে এগুতে পারবে না। তোমার লক্ষ্য যে অনেক দূরে। প্রেম-ভালোবাসা সবার জন্য আসেনি। '
নোরিন নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। খুব কি খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে নিবিড়ের সাথে আজ? খুব বেশি বলে ফেলেছে? নোরিনের মস্তিষ্ক আন্দোলন করলো,
---- না! তুমি কোনো ভুল করোনি। হয়তো আজও তোমাকে কোনো না কোনোভাবে কষ্ট দিতো। হয়তো আবার তোমাকে ছোট করতো। তুমি নিজের মনোবল হারাতে পারতে৷ নিবিড় শুধুই তোমার অতীত৷ তুমি এতো স্বস্তা নও। তোমার ভালোবাসাকে যদি সে তোমার দুর্বলতা ভেবে থাকে, তাহলে তাকে বুঝিয়ে দাও তুমি কি পারো আর কি পারো না। '
নোরিন চোখ বন্ধ করে তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে কাতর হয়ে আপনমনে বলতে লাগলো,
---- এতো কষ্ট কেন হচ্ছে? এতোদিন পর সে কি আশা করে এখানে এসেছে? তাকে দেখলেই আমার অতীত মনে পড়ে যায়, নিজের মন ভাঙার গল্পটা মনে পড়ে। নিজেকে অসহায় মনে হয়। কেনো আমি এমন? আমি তাকে ভুলতে পারিনি। কি করবো আমি? আমি কোনো মায়া রাখতে চাইনা। না পারছি তাকে সহ্য করতে.....
আলতো ছোঁয়ায় চোখের চাওয়ায়
পাওয়া না পাওয়া কি যে নেশা
সেই স্মৃতিটা আজো হাতড়াই,
হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা।
পরদিন,
সকালে পুরো এলাকা জগিং করে এসে নোরিন কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরলো। তার চোহারা নির্লিপ্ত। গতরাতে সে যে প্রাণ উজাড় করে কেঁদেছে, চেহারায় তার কোনো ছাপ নেই। খুব সুন্দর হেসে গার্ডেনের ফুলে পানি দিলো, গাছের অতিরিক্ত অংশ কাটিং করলো ফুরফুরে মেজাজে। বাগানের মালির সাথে কিছুক্ষণ কথাও বললো। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে নোরিনকে। ভীষণ সুন্দর এক অপরুপ রুপসী শহুরেকন্যা যেন বাগানে হেসেখেলে বেড়াচ্ছে।
একটুপর ঘরে ঢুকতেই, ডাইনিংয়ে তার বাবাকে বসে থাকতে দেখা গেলো। নোরিন ভালো করে তাকালোও না, দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতো উঠতে বললো,
---- বাবা জাস্ট পাঁচ মিনিট। আমি ছোটখাটো একটা শাওয়ার নিয়ে আসছি। তুমি খাওয়া শুরু করো।
আজমল সাহেব হালকা হাসলেন,
---- আমি একা কোথায়! নিবিড়কে দাওয়াত করেছি। আমাদের সাথে ব্রেকফাস্ট করবে।
নোরিন হাঁটা থামিয়ে অবাক হয়ে টেবিলে ভালো করে তাকালো। বাবার অপর প্রান্তের চেয়ারে নিবিড় চুপচাপ বসে আছে। নোরিনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ধুপধাপ পা ফেলে নিজের রুমের চলে গেলো সে। শাওয়ার না নিয়েই সে টেলিফোনে বাবার নাম্বারে ডায়াল করলো। তাদের বাংলোটা পুরোনো ধাঁচের। টেলিফোন ছাড়াও অারো অনেক পুরোনো আমলের জিনিস রয়েছে। আজমল সাহেব রিসিভ করেই বললেন,
--- কি ব্যাপার? ডাইনিং থেকে তোমার রুমের দুরত্ব কি খুব বেশি দূরে?
---- বাবা, নিবিড় ভাইয়াকে তুমি দাওয়াত করেছো কেন?
---- লাইলা বললো নিবিড় গতকাল এসেছিলো। আমি দেখা করতে পারিনি। ভাবলাম আজকের লাঞ্চ একসাথে করি। তাড়াতাড়ি নিচে এসো। আমরা অপেক্ষা করছি।
নোরিন গলার আওয়াজ খানিকটা খাদে নামিয়ে বললো,
---- আমি আসতে পারবো না।
---- কেনো কোনো সমস্যা?
---উফফ বাবা! তুমি বুঝবে না...
নোরিন বিরক্তি নিয়ে একটা,দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ভাবগম্ভীর মুখে শাওয়ার নিয়ে নিচে নামলো। নিবিড়ের দিকে না তাকিয়ে, আজমল সাহেবের পাশে বসে খেতে লাগলো। পুরো টেবিলময় নীরবতার ছায়া৷ কেউই বাড়তি কোনো কথা বলছে না। আজমল সাহেব দু-একবার ভাব জমানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু দু'পক্ষের কোনো সাড়া পেয়ে, তিনিও চুপ করে গেলেন৷ একপ্রকার গুমোট পরিস্থিতিতে সকালের নাস্তা শেষ করলো তারা।
বেলা তখন বারোটার ঘরে। নোরিন নিজের রুমে বসে মোবাইলে স্ক্রল করছিলো। তখনি আজমল সাহেব খবর পাঠালেন, নোরিনকে নিচে নামতে। নোরিনের প্রচন্ড রাগ লাগছে। ঐ নিবিড়ের সামনে আর যেতে ইচ্ছে করছে না। বাড়িতে আসাই ভুল হয়েছে মনে হচ্ছে। মোবাইলটা বেডে ছুঁড়ে, সে নিচে নামলো। জোরপূর্বক হাসলো সে। বাবাকে কিছুই বুঝতে দেওয়া যাবে না।
---- বাবা ডাকছিলে?
---- হ্যাঁ। আমি বাজারে যাচ্ছি আজ। জেলেপাড়ার কয়েকজনকে ইলিশ মাছের কথা বলে রেখেছিলাম৷ ছেলেটা এতোদিন পর এলো! তুমি নিবিড়ের সাথে থাকো। গল্প করো৷ আমি ড্রাইভারকে নিয়ে যাচ্ছি।
নোরিন বাঁধা দিতে চাইলো,
--- বাবা এতো গরমে তুমি যেওনা। আমি যাই?
---- না, অনেকদিন বাজারে যাওয়া হয়না। আজ নিবিড়ও এলো। জম্পেশ খাওয়া হবে। তুমি খেয়াল রেখো, ওর যাতে একা না লাগে।
আজমল সাহেব চলে গেলেন৷ নোরিনের নিজের মাথা ফাটাতে ইচ্ছে করছে। বিরক্তি নিয়ে একটা সোফায় ধপ করে বসে আড়চোখে নিবিড়ের দিকে তাকালো। নিবিড় একমনে রিমোট নিয়ে টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছে। ভাবমতি এমন যেন, নোরিনকে সে চেনেই না। নোরিনও স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে রইলো।
অনেকক্ষণ সময় অতিবাহিত হলো। নোরিনের সম্পূর্ণ মনোযোগ এখন টিভির দিকে। একটা নিউজ চ্যানেলের হেডলাইনে মনোযোগ ঢেলে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ অনুভব করলো, পাশের সোফায় কেউ বসেছে। নোরিন সতর্ক হয়ে পাশে তাকালো।
---- এতো জায়গা থাকতে আমার পাশে কেন বসেছেন? চোখে দেখেন না?
নিবিড় ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বললো,
--- চোখ আছে বলেই, এতো জায়গায় মধ্যে, আমার ইচ্ছে মতো একটা জায়গা সিলেক্ট করলাম।
নোরিন মুখ কুঁচকে আবার টিভির দিকে তাকিয়ে রইলো। অস্বস্তি হচ্ছে তার৷ কারণ নোরিনের মনে হচ্ছে, নিবিড় তার দিকে তাকিয়ে আছে।
নিবিড় টিভি অফ করে দিলো। নোরিন তবুও কাঠ হয়ে বসে, টিভির দিকেই তাকিয়ে আছে। বুকে অসহ্য অনুভূতি হচ্ছে। পারলে এক্ষুনি খুন করতো তাকে।
---- নোরিন আমার দিকে তাকা।
নোরিন সামনে তাকিয়েই জবাব দিলো,
--- কি হয়েছে?
নিবিড়ের দীর্ঘশ্বাস নোরিনের কানে এলো।
---- ভালোবাসিস কাউকে?
নোরিন স্পষ্ট গলায় বললো,
---- আমি কাউকে ভালোবাসিনি নিবিড় ভাইয়া। ভালোবাসবো না কাউকে। ভবিষ্যতেও না।
নিবিড় সোফার পেছনে মাথা এলিয়ে বসানো গলায় বললো,
---- তুই তাহলে চিঠিটা পড়িসনি? আমিতো ভেবেছিলাম....
--- কি ভেবেছিলেন? আমাকে আবার অপমানিত করা যায় কি-না? আমাকে কীভাবে ছোট করা যায় তাইনা?
নোরিন সরাসরি নিবিড়ের দিকে তাকালো। নিবিড় আজ একটা ধূসররঙা শার্ট পরে এসেছে। মুখের শেইপ অনেকটা ধারালো, তারউপর খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখগুলো এমন যেন সবসময় হাসছে, গায়ের রঙ ছেলে হিসেবে ভীষণ সাদা। ভ্রুতে একটা নিখুঁত কাটা দাগ খুব সুন্দর মানিয়ে গেছে। জিরাফের মতো লম্বা লম্বা পা দুটো সোফার সামনে ছড়িয়ে দিয়েছে। নোরিনের মনে হলো, এমন লম্বা ছেলে পুরো সেনানিবাস এলাকা ঘুরলেও একটা পাওয়া যাবে না। নোরিন তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে আবার সামনে চোখ রাখলো।
---- আমি জানতাম তুই কাউকে ভালোবাসিস। এখন বাসিস না? হঠাৎ এতো পরিবর্তন। কিন্তু কেন?
নোরিন নিজেকে সামলাতে চাইলো। গলা বেয়ে উঠে আসা কান্নার দলাকে সে কঠোর রুপে দমন করলো,
---- বাসতাম নিবিড় ভাইয়া, এখন না। যে আমার শরীরে কলংকের দাগ খুঁজে বেড়ায় তাকে কীভাবে ভালোবাসা যায়? তবুও আমি তাকে ভালোবাসি। বেহায়া হয়ে গিয়েছিলাম আমি, বারবার তাকে বুঝাতে, তার দোয়ারে হাজির হয়েছিলাম কিন্তু সে বারবার আমাকে অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছিল।অন্য করো ভুলের কারণে আমাকে দূরে ঠেলে দেয়, নীরব প্রত্যখ্যান করে বারবার। আমি বুঝতাম তবুও মন সায় দেইনি। সে যে আমার প্রথম এবং শেষ আবেগ ছিলো। যে আমার কিশোরী বয়সের প্রথম আবেগকে দূরে ঠেলে দেয়, তার সামনে কেন নিজেকে ছোট করবো? যাকে ঘিরে সাজিয়েছিলাম আমার অন্য এক পৃথিবী; হাজারটা রাত সাক্ষী, আমার চোখ সাক্ষী; কীভাবে আমি নিজেকে প্রস্তুত করেছি। আমি ঘুমাতে পারতাম না নিবিড় ভাইয়া! আমার সময় এক জায়গায় থমকে ছিলো। কথায় আছে না, কারো সময় কাটে না আর কারো সময় থাকে না। আমি কাউকে বলতে পারিনি সেই অসহ্য যন্ত্রণার কথা, ভেতরে শত-শতবার মরে গিয়েছিলাম। শুধুমাত্র আমার স্বপ্নই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো। আমার স্বপ্ন আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিলো। আর আমি আজকের নোরিন আলী সেরনিয়াবাত। আমি এখন কিশোরী বয়স পার করে এসেছি। বুঝতে শিখেছি, নিজেকে সামলে নিয়েছি। কোথাও হয়তো আজোও দুর্বল। তবে, নিজের দুর্বলতা কীভাবে লুকাতে হয় তাও রপ্ত করেছি। এতোকিছুর পর সে আমার কাছে কি আশা করে?
---- নোরিন.....
নিবিড়ের স্বরেও নোরিন ফিরলো না। আচমকা নোরিন ঘুরে বসলো। সরাসরি চোখ রেখে নিবিড়ের দিকে তাকালো। নিবিড়ও একমনে তাকিয়ে আছে। নোরিন গলা নামিয়ে বললো,
---- নিবিড় ভাইয়া আমার একটা কথা রাখবেন?
নিবিড় মিশ্র কণ্ঠে বললো,
--- তুই যা বলবি তাই করবো...
---- প্লিজ আপনি চলে যান। অনেকদূরে চলে যান যাতে আপনি-আমি চাইলেও একে অপরের মুখ দেখতে না পারি। আমার কথাটা রাখবেন?
নিবিড় পাথর হয়ে গেলো যেন। থমথমে গলায় জবাব দিলো,
---- আচ্ছা, চলে যাবো। কালই ইউএসএ চলে যাবো।
---- সত্যি নিবিড় ভাইয়া?
---- কছম চলে যাবো। তোকে আমার মুখ আর দেখতে হবে না। তোকে ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি।
নিবিড় নোরিনের মাথা ছুঁয়ে, ড্রয়িংরুম পেরুলো, তারপর সদর দরজা পেরিয়ে গমগমে পায়ে চলে গেলো। নোরিনের মুখে তখন হাসি থাকলেও, এখন কান্নার বাঁধ ভেঙে পড়লো। চোখভর্তি জল নিয়ে সে নিজের রুমে চলে গেলো। সে আজও বুঝলো না তাকে....
#চলবে