ওয়েবসাইট কাস্টমাইজেশন এর জন্য। Contact Us Welcome!

গল্প: ভালোবেসেছি তোরই মতো পর্বঃ ১৭

Bangla Dub Novels

 #ভালোবেসেছি_তোরই_মতো

#পর্বঃ১৭

#লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন


চট্টগ্রামের পূর্বে অরণ্য ছোঁয়া সীতাকুণ্ড পাহাড়ের হাতছানি আর পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের অনুপম জলের ঢেউ। এর মাঝেই অবস্থিত বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমী। নোরিন চট্টগ্রাম এসেছে আজ অনেকদিন। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো সে খুব সুন্দরভাবে নিয়মমাফিক উপভোগ করছে। ক্যান্টেনমেন্ট এরিয়ায় খুব ধরাবাঁধা নিয়মে নিজেকে বেঁধে নিয়েছে নোরিন। ভোর ছ'টার মধ্যে রেডি হয়ে প্যারেড গ্রাউন্ডে পৌঁছানো, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ছয় থেকে চল্লিশ কিলোমিটার পর্যন্ত দৌড়, টানা উঁচু নিচু পাহাড় অতিক্রম, বিভিন্ন ট্রেনিং আবার মাঝেমধ্যে নানা দুর্গম এলাকায় কয়েকরাত অবস্থান করে ব্যবহারিক অনুশীলন আরো শত শত কাজে নোরিন নিজেকে ডুবিয়ে ফেলেছে পুরোপুরি। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ভাববারও ফুসরত নেই যেন। 

ট্রেনিংয়ের এসব কাজ নোরিনের জন্য সাবলীল হলেও অনেকে মাঝেমধ্যে হাল ছেড়ে দেয়। হাপিয়ে পড়ে। কিন্তু নোরিনের কাছে মনে হয়, এই কাজে কখনো বিরক্তি আসতেই পারেনা। যেসব কাজকে আমরা ভালোবেসে সাদরে গ্রহণ করি, সেসব কাজে কখনো অবহেলা এবং একঘেয়েমি আসতে পারে না। 

নোরিন ক্যাম্পের সবার কাছে খুব পরিচিত মুখ। অফিসাররা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। একজন নন ক্যাডেট কলেজ স্টুডেন্ট হয়েও নোরিনের মাঝে যে মনোবল আর নিষ্ঠা দেখেছেন তা ক্যাডেট কলেজের ভালো ভালো স্টুডেন্টের কাছেও পাওয়া যায়নি। তাদের ভাষায়, নোরিন বেশ ডিসেন্ট একটা মেয়ে। ক্যাম্পের যে কারো বিপদে, বিপজ্জনক  ট্রেনিংয়ে সবার আগে এগিয়ে আসে। পারুক না পারুক সে কখনোই মনোবল হারায়নি এ পর্যন্ত। তার পারফরম্যান্স স্কিল এবং বিচারবুদ্ধি যথেষ্ট উন্নত। 

নোরিনের কয়েকজন বন্ধুও জুটে গেছে ইতিমধ্যে।  তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো সখ্যতা হয়েছে আলী সারতাজের সাথে। তার সাথে নোরিনের পরিচয়ও অদ্ভুতভাবে। প্রথমদিকে নোরিনের উপর বেশ ক্ষিপ্ত ছিল সে। একজন নন ক্যাডেট মেয়ের কাছে সে কিছুতেই নত হতে চায় না। বেশ অসহ্য লাগতো নোরিন নামের অহংকারী  মেয়েটাকে। কিন্তু একদিন একটা দুর্গম এলাকায় ফায়ারিংয়ের সময় অসাবধানে সারতাজের হাত কেটে যায়। এদিকে মেডিক্যাল অফিসারও বেশ দুরত্বে। তখন নোরিনই জংলী এক ধরনের পাতা দিয়ে ইনফেকশনের হাত থেকে বাঁচায়। 

--- আপাতত এটা দিয়ে কাজ হয়ে যাবে। টেন্ডে পৌঁছে ব্যান্ডেজ করে নিও।

সারতাজ বেশ অবাক হয়। তার চেয়ে বেশি অবাক হয় নোরিনের মুখ দেখে। মেয়েটা ভাবলেশহীন মুখে আবার আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে এমন শান্ত মুখে শুট করছে যেন কিছুই হয়নি। সারতাজ নামক কোনো প্রাণীর হাত কেটেছে এবং সে সাহায্য করেছে এমন কোনো অভিব্যক্তি তার মুখে নেই। নোরিনের এই ভাবটার জন্যই সারতাজ তাকে অপছন্দ করতো। কিন্তু সেদিনের পর থেকে কেমন যেন হয়ে গেল। সারাদিন নোরিনের কর্মকান্ড, মতিগতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে জানতে পারলো, মেয়েটা আসলে এমনই। ভাবগম্ভীর, চুপচাপ স্বভাবের। অফিসারদের সাথেই তার যত কথা। একদিন গ্রাউন্ডে প্র্যাকটিসের সময় নোরিনকে এককোণে দাঁড়িয়ে পানি খেতে দেখে সারতাজ তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। 

নোরিন বোতলে মুখ পুরে আড়চোখে একবার সারতাজের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। চোখ, মুখ স্বাভাবিক। সারতাজ পকেটে হাত গুঁজে বলে,

---- তোমার নামের পরে আলী, আমার নামের আগে আলী। আলী সারতাজ-নোরিন আলী। আমরা আলী স্কয়ার। 


নোরিন বোতলের ছিপি আটকে সারতাজকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সামনে এগিয়ে যেতেই সারতাজ সামনে এসে দাঁড়ালো।  নোরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

---- তো আমি কি করতে পারি? 


সারতাজ একহাত বাড়িয়ে বলে,

--- সো ফ্রেন্ডস? 


নোরিন হালকা হেসে সারতাজকে পাশ কাটিয়ে কয়েক কদম এগিয়ে আবার পেছন ফিরে তাকালো। দেখলো, সারতাজ এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। নোরিন তার হাতের বোতলটা ছুঁড়ে সারতাজকে এগিয়ে দেয়। একপাশে ঠোঁট প্রসারিত বললো,

--- ওকে। উই আর ফ্রেন্ডস ফ্রম টুডে। 


নোরিন কথাটা বলে চলে গেলে সারতাজের মুখে হাসি ফুটলো। অস্ফুটে বললো,

---- অদ্ভুত মেয়ে! অদ্ভুত তার বলার ভঙ্গি!  


দিন যায়, মাস আসে, বছর ঘোরে। সময় পাল্টালো। একমাসের ছুটিতে নোরিন কয়েকদিন পরেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। 

বাড়ি পৌঁছানোর আগের রাতে সবাই বেশ হুলস্থুল কান্ড করে বসলো। বাইরে বন ফায়ারের আয়োজন করে নাচ,গান হৈ-হুল্লোড়ে মাতে সবাই। নোরিন একটা বই নিয়ে চেয়ারে বসে আছে। সামনে সবাই আড্ডায় ব্যস্ত। স্যার আজ সবাইকে ছাড় দিয়েছেন তবে, কোনো উশৃংখল আচরণ করা যাবে না এই শর্তে। 

আগুনের জ্বলজ্বল করা আলো খানিকটা দূরে অবস্থান করা নোরিনকে মুখে পড়ছে। লাল আভায় তার মুখ অন্য ধরনের দীপ্তি এনে দিয়েছে। বাতাসের দোলে তার হেয়ার ব্যান দিয়ে আটকানো চুলগুলো একবার এক কাঁধে তো আরেকবার অন্য কাঁধে বারি খাচ্ছে। পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়েও নির্বিকার পড়তে লাগলো নোরিন। বইয়ে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করলো,

--- সারতাজ কিছু বলবে? 


সারতাজ উসখুস করছে। নোরিন আচমকা বলে বসলো,

--- তুমি আমাকে পছন্দ করো। এম আই রাইট? 


সারতাজ অবাকের শেষ প্রান্তে গিয়ে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অবাকতার রেশ কাটিয়ে বললো,

--- হ্যাঁ, তুমি আমাকে পছন্দ করো না? 


নোরিন বইয়ে দৃষ্টি রেখে ছোট করে বললো,

---- না। 


সারতাজের বিস্ময় আরো প্রশস্ত হলো। তার সাথে কথা বলার জন্য মেয়েরা মুখিয়ে থাকে। নিঃসন্দেহে   সে  ভবিষ্যতে ক্যাডেট অফিসার হবে। ডিসেন্ট, কুল, হ্যান্ডসাম। একটু আগেও একজন মেয়েকে রিজেক্ট করে এলো আর এখন? অবশ্য নোরিনও কম না। মেডিক্যাল অফিসার, ক্যাপ্টেন, প্রশিক্ষকরা পর্যন্ত নোরিনকে আড় চোখে দেখে। একজন নাকি নোরিনের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব অব্ধি পাঠিয়েছে নোরিনের অগোচরে। তবুও সারতাজের ধারণা ছিলো, নোরিন তাকে পছন্দ করে। কারণ, কারো সাথেই নোরিন তোমন একটা কথা বলে না। সারতাজ কষ্ট পেলেও মুখ স্বাভাবিক করে কথা চালিয়ে গেলো। বন্ধুত্ব নষ্ট করার কোনো মানেই হয়না। 

---- কেউ মনে আছে নাকি?


নোরিন পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লো,

--- তোমার কি মনে হয়? 


---- আমার মনে হয় কেউ নেই৷ 


নোরিন হালকা হেসে বললো,

---- ছিলো। 


নোরিনের কাছে এমন উত্তর আশা করেনি সারতাজ। বুকে যেন কেউ ছুরিঘাত করেছে। মনটা ক্রমশ ভার হয়ে আসছে। 

---- এখন নেই?


--- সেটা বলা যাবেনা।


সারতাজ আবারো হতাশ হলো। কি অদ্ভুত!  এতোদিনের বন্ধুত্বেও টের পেলো না কিছুই। নোরিন কত নিখুঁতভাবে নিজের ব্যাপারে সবকিছু গোপন করে গেছে৷ নোরিন মলিন হেসে সারতাজকে ডাকলো,

---- সারতাজ! ভালোবাসা এক অদ্ভুত মায়া। যেখানে নারী এক পুরুষকে অন্য পুরুষ হতে আলাদা করে রাখে আর পুরুষ তার নারীকে৷ আমিও অন্য কাউকে ভাবতে পারিনি।


নোরিনের মুখে ভালোবাসার কথা শোনে সারতাজকে আবারো অবাক হতে হলো৷ আগ্রহী কণ্ঠে বললো, 

--- সে তোমাকে ভালোবাসে না? 


নোরিন শক্ত কণ্ঠে বললো,

--- না। আজ এতোগুলো বছরের পরও আমি তাকে ভুলতে পারিনি। ঐযে বললাম, ভালোবাসা এক মায়া। আমার ভালোবাসা মিথ্যে ছিলো না সারতাজ! 


সারতাজের সামনে নোরিন এবার কাঁদতে শুরু করলো৷ নাক টানতে টানতে বললো,

---- আমি তাকে অসংখ্যভাবে ভালোবেসেছি সারতাজ,অসংখ্যবার ভালোবেসেছি, এক জীবনের পর অন্য জীবনেও ভালোবাসবো, বছরের পর বছর, সর্বদা,সবসময়। 


সারতাজের চোখও ভিজে এলো। চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষকে কাঁদতে দেখে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। নোরিনকে এমন ব্যাকুল হয়ে কোনোদিন কাঁদতে দেখেনি সে। অবশ্যই নোরিনকে রিজেক্ট করার ক্ষমতা কারো নেই। কারণ নোরিনের খুঁত ধরার মতো কিছুই নেই। কাজেকর্মে, গুণাবলিতে সে পারদর্শী। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে বলতে গেলে, নোরিন অপরুপ। সারতাজের এই মুহূর্তে সেই মহামানবকে স্বচক্ষে দেখার তুমুল ইচ্ছা জাগলো। 

---- আমি তার সাথে দেখা করতে চাই নোরিন। আমি তাকে বুঝিয়ে.... 


নোরিন যেন গর্জে উঠলো,

---- কক্ষনও না! তোমাকে আমি শুট করবো। জেনে রেখো, যদি তুমি কোনোদিন বলো, সেদিনই আমাদের বন্ধুত্বের শেষদিন। 


সারতাজ ভয় পেয়ে গেলো। পরক্ষণেই শান্ত কণ্ঠে বললো,

--- তুমি তোমার এই জীবন নিয়ে হতাশ নও? 


নোরিন ব্যঙ্গাত্বক হাসলো। নিজেকে সামলে নেওয়ার অপূর্ব দক্ষতা নিয়ে সে শান্ত স্বাভাবিক মুখে আকাশে চোখ রাখলো,

--- আমি আমার জীবন নিয়ে কখনোই হতাশ হয়নি সারতাজ। কে বলতে পারে, হয়তো আমার মতো জীবন পাওয়া অনেকের কাছে স্বপ্ন?  আমি নিজেকে নিয়ে খুব কমবারই আফসোস করেছি৷  ঝুঁকি নিয়ে সামনে এগিয়ে, প্রত্যেকটা সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জীবনকে উপভোগ করতে শিখেছি আমি। আজকের যে কাজগুলো করতে তুমি ভয় পেয়ে ছেড়ে দিলে, একদিন পেছন ফিরে দেখবে এবং বুঝবে, যে সুযোগগুলো হাতছাড়া করেছো, তা নিয়েই অনুতপ্ত হচ্ছো বেশি। 


----------------------

নোরিন বাড়ি ফিরেছে আর দুদিন হলো। নিবিড় হাজির একদিন। নোরিন বাবা অফিসে। নোরিন গার্ডেনের পানি দিচ্ছিলো আপন মনে৷ নিবিড় পেছন থেকে নোরিনের ঝুটি টেনে ধরলো। প্রচন্ড রাগ নিয়ে পেছন ফিরলো নোরিন। চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে তার৷ 


#চলবে.....

إرسال تعليق

Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.