#ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
#পর্বঃ০৫
#লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন
বাচ্চাপার্টির চ্যানচ্যানানি আর উঠতি বাচ্চাদের ট্যানট্যানানি এবং এর বড়দের ফ্যারফ্যারানি থেকে বাঁচতে বাড়ির বড়রা ঠিক করলো সবাইকে ঘুরতে পাঠিয়ে দেবে। শুধুমাত্র দুধের বাচ্চাদের ছাড়া সর্বনিম্ন সাত-আট বয়সী থেকে যত উপরে উঠা যায় বাচ্চারা মিলে ঘুরতে বের হলো। সবাইকে দেখে রাখার দায়িত্ব দেওয়া হলো মকবুল আর ছকিনার উপর। ছকিনা মকবুলের বোন। ওদের পূর্বপুরুষও এই বাড়িতে কাজ করে এসেছে।
নিবিড় সকল বাচ্চাপার্টির কাছে আগ্রহের বস্তু। নিবিড় ভাইয়া বললেই একপায়ে খাড়া সবাই। কি এমন জাদু করেছে কে জানে! খেতে বসলে নিবিড় ভাইয়ার সাথে খাবো, কোথাও গেলে নিবিড় ভাইয়ার সাথে যাবো, হাসলেও নিবিড় ভাইয়ার সাথে হাসবো। নিবিড় কয়েকজনকে কয়েকটা টুক্কি টাক্কা মানে আলতো চড়ও মেরেছে তবুও, তার জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি। বরং যাকে মেরেছে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আর তার দেখাদেখি অন্যরাও বলে, নিবিড় ভাইয়া ও'কে আদর করেছো আমাদের আদর করবে না? ঘুরতে যাওয়ার কথা শোনে তারা প্রথমে রাজি না হলেও, নিবিড় যাওয়ার কথা শুনে ঠিকই রাজি হলো।
অন্যদিকে, এই চিল্লানিযুক্ত ট্রেন থেকে বাঁচতে নোরিনও রাজি হলো। সে একটা কালো জিন্স আর ওয়ান পিস পড়ে যখন বাইরে বেরিয়ে এলো, তখন দেখা গেলো একমাত্র সে'ই বাকি ছিলো। বাকি সবাই রেডি হয়ে অলসপায়ে উঠানে পায়চারি করছে। নিবিড় মুখ কুঁচকে বললো,
---- এতো সেজেগুজে এসে কি হলো? সেই-তো পেঁচার মতো দেখতে লাগছে তোকে। শুধু শুধু সময় নষ্ট।
বলেই নিবিড় ব্যস্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলো। নোরিন পানসে মুখ করে অন্যদের দিকে তাকালো। তাকিয়ে বুঝলো, তাকে মোটেও খারাপ লাগছে না। বজ্জাত একটা! আপনাকে একদিন আমি সত্যি সত্যিই অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে বসাবো, আগাগোড়া পরীক্ষা করবো। নোরিন দোয়া পড়ে ফো দিলো।
প্রথমেই তারা পুকুর পাড়ে গেলো। পুকুরভরা শাপলাফুল। মকবুল নোরিনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। নোরিন তার মোবাইল নিয়ে চারপাশে ভিডিও করছে, বাবাকে দেখাবে বলে। জেরু,রাইদা,মিমহা, গালিব ভাইয়া, ইশরাক, ইশমাম, তাশরিক ভাইয়া সহ ছোট বড় সব কাজিনরা পেয়ারা পেড়ে খাচ্ছে। মকবুল আস্তে করে নোরিনকে ডাকলো তার তুতলানো স্বর দিয়ে,
--- আা-আফা...
নোরিন মোবাইলে মনোযোগ দিয়ে জবাব দিলো,
---- হুম, বলো!
মকবুল এবার নিজের কথার পসরা সাজালো।
--- জা-জানেন আফা কি হইছে? একদিন সকালে আমি পানি তুলতে আইছিলাম এইহানে। দেখি, দুইটা সাপ গড়াগড়ি খাইতাছে। একে অপরের সাথে পেঁচাইয়া সিঁড়ির পাড়ে উল্টাউল্টি করতাছে। তারপর দেখি, আরো পাঁচ-ছয়টা সাপ। একটা সাপ পেয়ারা গাছের সাথে ঝুলছে। আ-আফা একটা সাপের না দুইটা করে মাথা। আল্লাহর কসম কইতাছি! আমারে দেইখা লাল সাপটা এমন দৌড়ানি দিছে....! আমি আর এইদিকে একা আসি নাই।
ভয়ে নোরিনের আত্মা শুকিয়ে গেলো। মোবাইলটা এবার মকবুলের উপর তাক করে বললো,
---- সত্যি? আপনি দেখেছিলেন?
--- হ আফা... আপনি নিজের চোক্কে না দ-দ-দেখলে বিশ্বাস করতেন না।
---- এই মকবুল!!!! সর ওখান থেকে। সর বলছি...
নিবিড়ের ডাকে মকবুল ভয়ে দূরে সরে গেলো। নিবিড় নোরিনের পাশে দাঁড়ালো।
---- সকালে আমিও কয়েকটা সাপকে দেখেছি। পেয়ারা গাছটাতে বসে বসে পেয়ারা খাচ্ছিলো। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের বাড়িও দেখে এসেছি। চল তোকে নিয়ে যায়।
নোরিন চোখ বড় বড় করে বললো,
--- সত্যি নিবিড় ভাইয়া?
---সত্যি কি মিথ্যা তুই নিজেই যাচাই করিস!
নোরিন ভয়ে ভয়ে দূরে সরে এলো। এসব প্রাণীতে তার ভীষণ ভয়। একদিন প্র্যাকটিক্যাল করার সময়, ব্যাঙ কাটতে গিয়ে সে নিজেই বেহুঁশ হয়ে পরেছিলো। আরেকদিন হাতে কেঁচো লেগেছিলো বলে, তিনদিন পর্যন্ত হাত দিয়ে ভাত খায়নি। কিভাবে কিলবিল করছিলো ইয়া লম্বা কেঁচোটা ভাবলে এখনো গা গোলায় তার।
এতো বড় বাহিনী দেখলে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে। রাস্তায় মানুষ হাঁটার জায়গা পাবে না। মানুষ ভাববে সবাই হরতাল করতে বেরিয়েছে। এসব বিষয় চিন্তা করে নিবিড় ঘোষণা করল, এই বাচ্চা বাহিনী মকবুল আর ছকিনার অধীনে থাকবে। আর ইয়াংস্টার'রা থাকবে নিবিড়ের অধীনে। দুঃখে কষ্টে মকবুলের মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেলো।
দল বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর নিবিড় সবাইকে নিয়ে ধান ক্ষেতে গেলো। শীতকালের শুরু। বিস্তর প্রান্তর জুড়ে যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই ধান আর ধান। কাঁচা ধানের গন্ধে চারপাশ ম-ম করছে। কুয়াশার বেড়াজালে অর্ধেক মাঠ দৃষ্টিগোচর হলো না। তাতে যেন সৌন্দর্য আরো বেড়ে গেলো। নোরিন ধানি জমির আইল ধরে খানিকটা হাটলো। পা ভাজ করে নিচু হয়ে দেখলো ছোট ছোট পুঁটিমাছ ঘুরঘুর করছে। কয়েকটা কচুচিংড়ি মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে নরম মাটির ভেতরে নিজেদের আত্মগোপন করার চেষ্টা করলো। নোরিন হালকা হেসে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সবেমাত্র বিকেল। হলুদাভাব সূর্যটা যেন নিজের খানিকটা রঙ দিয়ে নোরিনকে সাজাতে চাইলো। ফর্সা মুখে হলুদের আলোয় অন্যরকম মায়া সৃষ্টি করেছে। খোলা চুলগুলো অবিন্যস্ত ভাবে উড়ছে। ধানি হাওয়া, মুক্ত প্রান্তর একটা তাজা প্রাণ।
নোরিন আগ্রহবশত কাঁচা ধানের একটা গাছি নিয়ে কামড় দিলো। দাঁতটা খসখস করে উঠল। সে জানতে চায় কাঁচা ধান খেতে কেমন। অমনি একটা চিৎকার ভেসে এলো,
----- আল্লাহ্ আল্লাহ্! এই তোকে কি আমরা ভাত দিইনা? ঘুরতে এসে আস্ত কাঁচা ধান খাচ্ছিস! কার না কার হক! বোন প্লিজ তুই ওই গাছটাকে রেহাই দে... বাড়ি গিয়ে তোকে এক গামলা ভাত দেবো প্রমিস...
নিবিড় কথা শোনে নোরিনের মনে হলো এক্ষুণি কচুচিংড়ি হয়ে মাটির নিচে লুকায় গিয়ে। এতো অপমান! এতো ড্যাশিং একটা মানুষের মুখ দিয়ে এমন কথা কীভাবে বের হয়? আপনার মুখে এসব কথা মানায় না নিবিড় ভাইয়া। ওহে সৎ মামাতো ভাই! আপনি আমাকে বোন ডাকবেন না প্লিজ।
নোরিন নির্বিকার মুখে ধান গাছটাকে ছেড়ে চলে এলো। জেরু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে। নোরিন এমন কথা কেনো সহ্য করছে? সে তো এসব কথাকে পশ্রয় দেওয়ার মতো মেয়ে নয়।
সবাই এবার গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে এলো। গালিব ভাইয়ার দুষ্টমিতে সবাই কিছুক্ষণ পর পর হাসছে৷ সবাই হাসছে শুধু হাসি নেই নোরিনের মুখে৷ তার চোখ ছলছল করছে। একসময় এই রাস্তা দিয়ে সে আর তার মা নানুভাইয়ের কবর জিয়ারত করতে আসতো। মা বারবার বলতো, মা মারা গেলে যেন নানুভাইয়ের পাশে কবর দেওয়া হয়। মায়ের শখ পূরণ হয়েছে। এই রাস্তা, এই মসজিদ, নানাভাইয়ের কবর সব আগের মতোই আছে, নেই শুধু মা।
সবাই নানাভাইয়ের কবরের পাশে গেলো জিয়ারতের উদ্দেশ্যে। নোরিন গেলো না। সে একমনে তাকিয়ে আছে পাশের কবরটাতে। জিয়ারত শেষ হলে, নিবিড় নোরিনের হাত ধরে টান দিলো। জানতে চাইলো, কেনো সে দোয়া করলো না? নোরিন এখনো নড়লো না। নিবিড় এবার জোরে বললো,
--- ওদিকে তাকিয়ে কি দেখছিস?
পাশ থেকে জেরু মিনমিনে গলায় উত্তর দিলো,
--- ওটা ওর মায়ের কবর। ওখানে দিলারা খালামণি ঘুমিয়ে আছেন।
চলবে
#Sadiya_Chowdhury_Noon
(আসসালামু আলাইকুম৷ সবার একটা কমন প্রশ্ন কেনো এতো ছোট পার্ট দিচ্ছি?আসলে আমার কোনো উত্তর নেই। এই করোনা আমার পরিবারে হানা দিয়েছে। কি খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে আছি, বুঝবেন না। তবুও লিখি যাতে আপনারা আমাকে, আমার গল্পকে ভুলে না যান। দোয়া করবেন।)