#ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
#পর্বঃ১৮
#লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন
নোরিন বাড়ি ফিরেছে আর দুদিন হলো। নিবিড় হাজির একদিন। নোরিনের বাবা অফিসে তখন। নোরিন গার্ডেনের পানি দিচ্ছিলো আপন মনে৷ নিবিড় এসে পেছন থেকে নোরিনের ঝুটি টেনে ধরলো। প্রচন্ড রাগ নিয়ে পেছন ফিরলো নোরিন। চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে তার।
কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পর নোরিন ডানহাতে নিবিড়ের হাত মচকে ধরলো। আর্মি ট্রেনিংগুলো এতোদিন পর কাজে এসেছে তার। চোখ গরম করে বললো,
---- নেক্সট টাইম এমন করার সাহস দেখাবেন না নিবিড় ভাইয়া। সময় বদলে গেছে। আমি এখন আর আগের মতো নেই।
নোরিনের ইঙ্গিত করা কথাটা খুব সহজে বুঝে ফেললো নিবিড়। হালকা হেসে সর্বশক্তি দিয়ে অপর হাত দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো।
---- বুঝলাম তুই অনেক কিছু পারিস। কিন্তু নিবিড়ের শক্তির কাছে তোর শক্তি কিছুই না। তুই সেনাবাহিনীতে যা, আর পাতিবাহিনীতে যা, তুই একটা মেয়ে৷ মেয়েদের শক্তি ছেলেদের তিনভাগের এক ভাগ।
কথাটা বলে বেশ আরাম করে নিবিড় পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়ালো। নোরিন চোখ নামিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে, যেটা একটু আগেই নিবিড় মুচড়ে ধরেছিলো। এর মাথা বরাবর ফোকাস করে ফায়ার করা উচিত। এতো বড় সাহস!!! নোরিন ভ্রু নাচিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বললো,
---- আপনি জানেন? আমি এখন একজন ক্যাডেট। কয়েক বছর পরই অফিসার হয়ে বের হবো। এখন থেকেই আমাদের নিরাপত্তার জন্য বডিগার্ড দেওয়া হয়েছে। ওদের কাঁধে সবসময় বন্দুক ঝুলানো থাকে। নেহাৎ আমি এখন বাড়িতে নাহলে, ওরা এক সেকেন্ড সময় না নিয়ে, আপনার এই বেয়াদবির জন্য, তাদের মিনিমাম দশ বারোটা চড় আর লাথি আপনার কপালে জুটতোই। আর....
নিবির নোরিনকে আর বলতে না দিয়ে নিজের হাসি আরো প্রশস্ত করে বললো,
---- হ্যাঁ জানি তো, ওদের কাজ কি! এ বলদ বডিগার্ড তোকে পাহারা দেয় সবসময়। তুই বাথরুমে গেলেও বলদ দুটো তোর সাথে থাকে। একজন দরজার ছিটকিনি খিল দেয়, আরেকজন টয়লেট টিস্যু পেপার হাতে.....
নোরিন নিবিড়ের মুখ চেপে ধরলো। কি পরিমাণ অসভ্য হয় মানুষ! কি চরম বেয়াদব হলে মানুষের মুখ এমন লাগামহীন হয়! অপমানে নোরিন গাল লাল করে বললো,
---- আপনি এখান থেকে চলে যান। নোরিন আলী সেরনিয়াবাত এখন এসব ছোটখাটো বিষয়ে সময় নষ্ট করেনা। তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।
নিবিড়ও এবার রেগে গেলো। নোরিনের দিকে তেড়ে এলো সে,
----- কি বললি তুই? কাজ শেখাস আমাকে? তুই কি করেছিলি তোর মনে নেই? আমি কেন এসেছি তুই জানিস না? এতোবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম তুই ইগনোর করে গেছিস। কমসেকম বিশবার খানেক সেনানিবাসে গিয়েছি। তোর জন্য আমাকে ভেতরে ঢোকার অনুমতিপত্র পর্যন্ত দেয়নি ওরা। তুই নাকি নিবিড় নামে কাউকে চিনিসই না! মজা নিস আমার সাথে?
নোরিন নিবিড়কে পাত্তা না দিয়ে পানির ঝাঁঝরি তুলে বাড়ির ভেতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। নিবিড় আবার সামনে এসে পথ আগলে দাঁড়ালো,
---- আলি সারতাজ কে? ফেইসবুকে দুইজন তো বেশ রঙ মাখামাখি করে ছবি ছাড়ছিস। আবার সবাইকে বলে বেড়াচ্ছিস, উই আর বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি কিছু বুঝিনা ভেবেছিস? তুই আজ আমার উত্তর না দিয়ে যেতে পারবি না নোরিন।
---- আপনাকে বলতে আমি বাধ্য নই। বুঝতে পেরেছেন?
---- সারতাজের সাথে কথা বলবো আমি!
----- আপনাদের মতো জঘন্য মানুষদের সাথে সে কথা বলেনা।
---- তুই এমনভাবে বলছিস যেন আমি রাস্তার কুকুর! কি মনে হয় তোর আমাকে? তুই সেনাবাহিনীতে গিয়ে অনেক বড় কিছু হয়ে গেছিস? আমি কয়েকদিন পর আমেরিকা চলে যাবো এমআইটিতে। কোটি টাকা স্যালারি হবে আমার।
নোরিন এবার টোল পরা হাসি নিয়ে বললো,
--- তো? আমি কি করবো? আপনার এই সফলতার গল্প অন্য কাউকে শোনান প্লিজ!
নিবিড়ের চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কপালের রগ টনটন করছে। লাথি মেরে সে বাগানের একটা টব ভেঙে ফেললো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করলো।
---- জানতাম কথ বলবি না। ত্যাড়ামো স্বভাব তোর। এখন এটা দয়া করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়।
নোরিন নিতে না চাইলে নিবিড় জোর করে তার হাতে পোরে দেয়। নোরিন হাত মুঠ করে দৌড়ে নিবিড়কে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে, একেবারে নিজের রুম বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। অনেক বড় সাহসের কাজ করে ফেলেছে আজ। হাত মুঠ থেকে কাগজটা ধরে, একেবারে ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে কাগজটাকে পুড়িয়ে ফেললো সে। পড়ার কোনো প্রয়োজনবোধ করলো না। সময় পেরিয়ে গেছে। এসব পড়ে অতীতে ফিরে যাওয়ার কোনো মানেই হয়না। এতোটাও স্বস্তা নয় সে। নিজেকে আর দুর্বল করবে না কোনো মতেই। ঐশ্বরিক হাসি নিয়ে নোরিন কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।
এদিকে ক্রমাগত দরজায় বারি দিয়ে যাচ্ছে নিবিড়।
--- নোরিন পড়েছিস তুই?
--- দরজা খোল....নোরিন!!!
--- প্লিজ দরজাটা খোল নোরিন! আমি সরি....
দরজা ধাক্কানোটা নোরিনের কাছে একটা টিউনের মতো মনে হচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি সে ঘুমের অতলে ডুবে গেলো।
নোরিনের যখন ঘুম ভাঙলো, তখন পুরো রুমে অন্ধকারের রাজত্ব। জানালা খোলা, মশা অনায়াসে নাচতে নাচতে ভেতরে ঢুকছে। নোরিন সবকিছু ঠিকঠাক করে নিচে নামলো। ডিনারের টাইম পেরিয়ে যাচ্ছে। লাইলাকে টেবিলে খাবার সাজাতে দেখা গেলো। বাবা টিভি অন রেখে বই পড়ছে মনোযোগ দিয়ে। বাইরে বজ্রপাত হচ্ছে। একটু পরপর প্রকট আওয়াজ করে যাচ্ছে। বৃষ্টি নামলো বলে! লাইলার কাছে জানতে পারলো, নিবিড় অনেক আগেই চলে গেছে। যাওয়ার সময় নাকি নিবিড়কে কাঁদতেও দেখেছে। ভীষণ হাসি পেলো নোরিনের। নিবিড় কখনো কাঁদতেই পারে না। লাইলা সবসময় ভুল ভাল দেখে। সেদিন বললো, সে নাকি ভূত দেখেছে। গাছের উপর দাঁড়িয়ে ছিলো সাদা শাড়ি পরে। এটাও নিশ্চয় তেমনি ভুল ছিলো!
নোরিন আজমল সাহেবকে ডাকতে গেলো,
---- বাবা খাবার রেডি। চলে এসো।
আজমল সাহেব বিনা বাক্য ব্যয়ে ডাইনিংয়ে গেলেন। নোরিন প্লেটে ভাত নিতে নিতে বললো,
---- অফিস কেমন কাটলো আজ?
আজমল সাহেব আনন্দিত কণ্ঠে বললেন,
---- আজ অফিসে কি হয়েছে শুনলে তোর হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যাবে।
---- তাই? কি হয়েছে শুনি।
---- দুপুরে তাজউদ্দীনকে বললাম আমার সাথে লাঞ্চ করতে। বেচারা তো ভয়ে শেষ! আমিও জানতাম না সে রোজা আছে। খাওয়ার পর রীতুর কাছে শুনি সে রোজা ছিল, ভয়ে 'না' বলতে পারেনি।
--- এটা মোটেও কোনো হাস্যকর ব্যাপার না বাবা! খুব খারাপ হয়েছে উনার সাথে।
আজমল সাহেব অপরাধীর সুরে বললেন,
--- আমি কি জানতাম! সবাই হাসছিলো। গরুটা আমাকে একবার বললেই পারতো! সারাদিন গাধার মতো ঘুরবে, টু টু করবে, কিছু বললেই লাজুক হাসবে।
নোরিন ফিক করে হেসে দিলো। বাবা মানুষটায় অদ্ভুত।
---- আচ্ছা তোর ট্রেনিংয়ের কথা বল। আমি একটু শুনি।
নোরিন মাথা কাত করে কিছু ভাবার চেষ্টা করলো। বাবাকে কি বলা যায়?
---- নতুন নতুন ওখানে গিয়ে একদিন কি হলো জানো? সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করেছিলাম। শাস্তি হিসেবে ম্যাম পুরো দু'ঘন্টা কড়া রোদে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো। এরপর আমি আর এমন ভুল করিনি। আরেকবার ক্যাম্পিংয়ে পাহাড়ে গিয়েছিলাম, একজনকে একেক দায়িত্ব দেওয়া হলো। মূলত ওখানে গিয়েছিলাম একটা প্র্যাকটিসে। 'অনুশীলন লালঘোড়া' নাম বলে। এটার মানে হলো, সব ক্যাডেটদের শত্রুসীমার ভেতরে থেকে নিজ বাহিনীর সাহায্য ছাড়া কীভাবে আক্রমণ পরিচালনা করা যায়, তা ব্যবহারিকভাবে শিক্ষা দেওয়া৷ স্যার আমাকে এই দায়িত্বটা দিয়েছিলো বাবা। তুমি ভাবতে পারছো? এতোজন থাকতে তারা আমাকেই লিডার বানালো। আমি অপারেশনটা সাকসেসফুলি কভাব করতে পেরেছিলাম৷ স্যার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, " মিস জেন্টলওম্যান! নোরিন আলী সেরনিয়াবাত ইউ আর দ্যা বেস্ট। " আমার তখন এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আমার স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেলো!
নোরিন অনর্গল বলেই যাচ্ছে। বাবার সামনে তার কথার বাঁধ বেঙেছে যেন আজ। তার চোখেমুখে এক অন্য ধরনের দ্যুতি খেলা করছে। আজমল সাহেব ছলছল করে গর্বভরা দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। তার ছোট্ট মেয়েটা আজ কত বড় হয়ে গেলো।
---- মা! ভালোবাসিস কাউকে?
নোরিন একটা ঢোক গিলে বাবার দিকে তাকালো। বুকে যেন কে পাথর বেঁধে রেখেছিলো। কষ্ট কমাতে এতো কথা বলছিলো এতোক্ষণ বাবার সাথে। বাবা কি কিছু বুঝে গেলো নাকি? চামচ নাড়াতে নাড়াতে বললো,
---- না বাবা। আমি কাউকে ভালোবাসিনি।
---- আমি তোমার বাবা। চিনি তোমাকে। একটা কথা মনে রাখবে, পছন্দের জিনিসকে সময় থাকতে নিজের করে নিও। দেরি যেন না হয়... জীবনটা খুব ছোট। তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছো। আমি তোমাকে বাঁধা দেবো না।
নোরিন কান্না মুখে বললো,
--- তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো কেন বাবা?
--- আশ্চর্য! আমার মেয়েকে আমি ভালোবাসবো না?
#চলবে
(আসসালামু আলাইকুম। গল্পের আর মাত্র কয়েকটা পর্ব বাকি আর আপনারা রেসপন্স করা কমিয়ে দিয়েছেন। গল্পটি পড়ে থাকলে অবশ্যই রেসপন্স করবেন। আমাকে হতাশ করবেন না প্লিজ। আরেকটা কথা বলি, আপনারা হয়তো কখনো বলেননি। তবুও বলছি, এই গল্পের দু'একটি বিশেষ উক্তি এবং কবিতা আমি মনীষিদের বই থেকে সংগ্রহ করেছি। ধন্যবাদ।)