ওয়েবসাইট কাস্টমাইজেশন এর জন্য। Contact Us Welcome!

গল্পঃ ভালোবেসেছি তোরই মতো পর্বঃ ০৬

Bangla Dub Novels

 #ভালোবেসেছি_তোরই_মতো

#পর্বঃ০৬

#লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন


নিবিড় নোরিনের হাত ধরে টান দিলো। জানতে চাইলো, কেনো সে দোয়া করলো না? নোরিন এখনো নড়লো না। নিবিড় এবার জোরে বললো,

--- ওদিকে তাকিয়ে কি দেখছিস? 


পাশ থেকে জেরু মিনমিনে গলায় উত্তর দিলো,

--- ওটা ওর মায়ের কবর। ওখানে তিনি ঘুমিয়ে আছেন। 


নিবিড় সাথে সাথে অবাক হয়ে তাকালো নোরিনের দিকে। তার চোখে খেলা করছে প্রবল বিস্ময়।


সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসছে। আকাশের লাল লাল আভাটা গায়েব হয়ে কালোতে রুপান্তরিত হচ্ছে। নোরিন একদৃষ্টি তাকিয়ে আছে তার মায়ের কবরে। সিমেন্ট দিয়ে বাঁধায় করা কবরটার মাথার কাছে একটা বকুল গাছ। নোরিন নিজে এই গাছটা রোপন করেছিল মায়ের মৃত্যুর একমাস পর। দিলারা বকুল ফুল খুব পছন্দ করতো। দীর্ঘ তিনবছরে গাছটা অনেক বড় হয়েছে। কুঁড়ি হয়েছে, ফুল হয়েছে। সাদা সাদা  ফুলে পুরো কবরটা ছেয়ে আছে। তীব্র মোহনীয় গন্ধটা অনেকদূর পর্যন্ত চলে গেছে। নোরিন আপন মনে বলছে, 

---- মা, তুমি কি শুঁকতে পারছো তোমার প্রিয় ফুলের ঘ্রাণ? দেখো গাছটা কত বড় হয়ে গেছে, ফুলগুলো তোমাকে একেবারে ঘিরে ফেলেছে। ওদেরও বুঝি তোমাকে খুব পছন্দ? 


নিবিড় নোরিনকে আবার ডাকলো। নোরিন ফিরলো না। নোরিন যেন এখন বাস্তবতায় নেই। কোনো এক জাদুর বলে মায়ের সাথে সাক্ষাতে ব্যস্ত। আচমকা আরো হেচকা টানে তার ভীষণ রাগ হলো। কার এতো সাহস? কে বাঁধা দেয়? ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিবিড় তাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে।  পেছন পেছন বাকিরাও আসছে। নোরিন এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। 

---- ডোন্ট টাচ্ মি। জাস্ট গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার!!! ডোন্ট ট্রাই টু ডিসটার্ব মি এন্ড লিভ মি এলোন। এখনো চেনেন নি আমাকে.... 


নিবিড় হাত ধরতে চেয়েও আর ধরলো না। সে হতবাক হয়েছে। নোরিন যে এমন কথা বলতে পারে তার ধারণাতেও ছিলো না। 

নোরিন গটগট পায়ে আবার আগের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। মাথায় বড় রুমালটা দিয়ে কপালে আরো ভালোভাবে পেঁচিয়ে শক্ত করে গিট মারলো। 


নোরিন যাওয়ার পর জেরু নিচু গলায় বললো,

--- নিবিড় ভাইয়া আপনি কিছু মনে করবেন না। নোরিন ও'র মায়ের কবরে আসলে এমন ইন্ট্রোভার্ট আচরণ করে।  খালামণির মৃত্যুর পর ও পুরো পাল্টে গেছে। খালামণি যেদিন মারা যান সেদিন নোরিন কতবার যে জ্ঞান হারিয়েছে হিসেব নেই। তাই আপনি কিছু মনে করবেন না নিবিড় ভাইয়া। আমরা নাহলে অপেক্ষা করি ও'র জন্য। 


নোরিন একা একা দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তার বিশ্বাস সে যা যা বলছে, সব কথা মা শুনতে পাচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি,  কলেজে অ্যাটিচিউড আইকন খ্যাত নোরিন শুধুমাত্র মায়ের সামনে দাঁড়ালে বাচ্চা হয়ে যায়। যে কিনা কারো সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করেনা, এই জায়গায় দাঁড়ালে কথার চেয়ে কান্নার পাল্লা ভারী হয়। 


----- মা কতদিন তোমায় জড়িয়ে ধরিনি৷ আজ কতদিন পর তোমার সাথে দেখা হলো বলোতো? মা তুমি জান? আমার এখন আর কোনো বেস্ট ফ্রেন্ড নেই। জানো নানুবাড়িতে সবাই আমাকে অনেক আদর করে। সবাই। কিন্তু তোমার অভাবটা আরো বেশি গ্রাস করে আমাকে এই গ্রামে আসলে। জেরুকে যখন ওর আম্মু মাছের কাটা বেছে দেয়, তখন তোমাকে মনে পড়ে। যখন আলভীকে ওর আম্মু চুল আছড়িয়ে দেয়, তখন তোমাকে মনে পড়ে। প্রতিদিন যখন ছোট্ট মুনিরা ওর মায়ের কোলে চড়ে বসে, আমার মনে পড়ে আজ অনেকদিন তোমার চুমু আমার কপালে আল্পনা আঁকেনি। মা, কতদিন মন খুলে হাসি না তুমি জানো? বাবা এখনো আমাদের তিনজনের ফ্রেম করা ছবিটার দিকে তাকিয়ে কাঁদে। আম্মু তুমি চলে আসো প্লিজ! আমি তোমাকে একবার ছুঁতে চাই। জাস্ট একবার। আমাকে আর বাবাকে দেখার কেউ নেই মা। আমাকেও তোমার কাছে নিয়ে চলো আম্মু। 

নোরিনের কান্নায় ভারী হচ্ছে আশেপাশের পরিবেশ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কবরস্থানের আশেপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমেছে। গাছের পাতাগুলো নড়ছে। কোনো একটা পাখির বিস্রী ডাক যেন অশুভ বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে। 

নোরিন ধীরে ধীরে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। ঠিক এজন্যই ও মায়ের কাছে আসতে চাইনা। এই অবস্থা হবে বলে। নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না বলে। নোরিন আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো জেরুরা কেউই নেই৷ হয়তো চলে গেছে। নোরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথার উপর থেকে রুমালের বাঁধন খুলে চোখ মুখ মুছলো। এখানে থাকা আর ঠিক হবে না বলে চলে আসতে লাগলো। শেষ বারের মতো একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো মায়ের কবরের দিকে। মা যেন দূরে দাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে নোরিনকে। নোরিন চোখ মুছলো শেষ বারের মতো৷ ঘাড় ফিরিয়ে আবার এই অন্ধকারে সাবধানে হাঁটতে শুরু করল। শুকনো পাতার মরমর আওয়াজ হচ্ছে শুধু। 

নোরিন একা একা রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। গ্রামে সন্ধ্যা মানেই রাত। একটা কানামাছিও দেখা যায়না। নোরিনের ভয় লাগছে না একটুও। এই রাস্তা তার চেনা, এই গ্রামের অলিগলি তার চেনা তাহলে কীসের ভয়। আচমকা কেউ ডাকলো পেচন থেকে, 

---- বুড়ি??? 


নোরিন অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে তাকালো। নিবিড় তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে হাত ভাজ করে। পরণের কালো পাঞ্জাবীটা কালো আঁধারের সাথে মিশে গিয়ে একেবারে জমকালো লাগছে। তবে মুখটা আঁধারেও ঝাপসা চকচক করছে। হাতদুটো তো মুখের চেয়েও ফর্সা। নোরিন বুক ব্যাথা শুরু হতে গিয়েও হলো না। চোখ সরিয়ে হাঁটতে লাগলো। নিবিড়ও খানিকটা সামনে এগিয়ে বেশ দুরত্ব রেখে হাঁটতে লাগলো। 

---- ভয় পাসনি? 


---- না! ভয় পেলে আর্মি অফিসার হওয়া যায় না।


----  অদ্ভুত তো! তা কেনো পাবি তুই তো শেওলা গাছের পেতনি। তোর কলিজা আছে বলতে হবে। তুই কিনা ওই কবরস্থানে এতোক্ষণ অব্দি থেকে আসতে পারলি? একবার কি হয়েছিলো জানিস? আমার একটা বন্ধুকে কবরস্থানে রাত দশটা অব্দি বটগাছের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিলাম। শালা নাকি ভয় পাইনা! আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে দশটার পর গিয়ে দেখি ব্যাটা বেহুঁশ। ভাবছি তোকেও বেঁধে রাখবো একদিন। 


নোরিন প্রতিবাদ করলো না। 

---- বাকিরা কোথায়? 


--- কোথায় আর যাবে বলতো? আমি সবাইকে বিদায় দিয়েছি৷ নাহলে সবাই টেনশন করতো। আমি আবার নিজের ইচ্ছায় তোর সাথে থাকিনি বুঝলি তো? আমি একজন স্বাধীনচেতা, সচেতন পুরুষ হিসেবে, একজন ভালো মানুষ হিসেবে একটা অসহায় ভেজালযুক্ত মেয়েকে দেখে রাখছিলাম। তুই হলি রাতকানা বুঝলি? আমি যে মসজিদের ওই কাঁঠালগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম তুই দেখিসনি? 


--- কই নাতো! 


নিবিড় হতাশ গলায় বললো,

--- তোর হাসি পাচ্ছে না? 


--- না! 


তারপর দুজনেই চুপচাপ। চুপচাপ সবকিছু। রাস্তার দুইপাশের ঝোপঝাড় গুলোতে জোনাকি পোকাগুলো নিজেদের সবুজ আলো নিয়ে একবার জ্বলছে, আরেকবার নিভছে। জ্বলছে, নিভছে। দুই নর নারী চুপচাপ হেঁটে চলেছে গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে। কাঁচা ইট বসানো রাস্তা। হাঁটতে বোশ লাগছে নোরিনের। নোরিন ছোট করে বললো,

--- সরি। 


নিবিড়েরও একই কথা,

--- আমিও সরি। 


--- কেন?


--- আমি জানতাম না যে আমি একজন ফুপি নেই। মানে মারা গেছে। আসলে আমি জানতাম না এই ব্যাপারে। 


নোরিন শুনতে লাগলো নিবিড়ের কথাগুলো। শহুরে টান মিশ্রিত কথা। বেশ অমায়িকতার সাথে, স্মার্টলি নিবিড় বলে যাচ্ছে। নোরিনের শুনতে ভালো লাগছে। 

--- আমি সরি কারণ আমি আপনার সাথে মিসবিহেভ করে ফেলেছি। আমি তখন কন্ট্রোলে ছিলাম না। 


--- করে ভালোই করেছিস। তোর আসল রুপটা চিনে নিয়েছি। সাক্ষাৎ একটা ড্রাকুলা তুই। ভাল্লুকের নানী। 


নোরিন ইচ্ছে করেই বললো,

--- নিবিড় তোমার গা দিয়ে বেশ খারাপ একটা স্মেল আসছে। তুমি এতো এতো পারফিউম ইউস করো কেনো? আমার বমি পাচ্ছে।  


নিবিড় রাগে নিজের দুরত্ব কমিয়ে ফেললো। নোরিনের হাত ধরে একেবারে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। একটা যুগলের মতো লাগছে দুজনকে। নোরিন ঠোঁট চেপে হাসলো। হাসিটা আঁধারের মতোই অন্ধকারে হারিয়ে গেলো। নিবিড় ফোস ফোস নিশ্বাস ছাড়ছে।

--- বেয়াদব!  কি বললি তুই?  আমি বাজে পারফিউম ইউস করি? জানিস এটার দাম কত? তোকে বেচলেও তো এতো টাকা পাওয়া যাবে না ডাফার। আর শোন, তুমি ডাকলি কোন সাহসে? আপনি বলে ডাকবি, আপনি।


নোরিন নাক কুঁচকানোর ভান করে বললো,

--- ভাইয়া প্লিজ দূরে সরে দাঁড়ান। আমার সত্যি বমি পাচ্ছে।  গলা অব্দি এসে গেছে। এক্ষুণি বেরিয়ে আসবে। 


--- কর বমি। করে গা ভাসিয়ে দে। সরবো না। এই গন্ধযুক্ত পারফিউম দিয়ে আজ তোর গা আমি মাখামাখি করবো৷ 

বলে আরো কাঁধ ঠেকিয়ে হাঁটতে লাগলো। আবার সব চুপচাপ। নোরিনই এবার শুরু করলো। 

---- আমাদের ভাবী আছে? 


--- না। 


--- বিয়ে করছেন কবে? 


--- বিয়ে করবো না। দেবদাস হয়েই কাটিয়ে দেবো সারাজীবন। বিয়ে করে লাভ কি বল। বিয়ে মানেই নিজের অর্ধেক স্বাধীনতা কমে যাওয়া।


নোরিন মনে মনে ভীষণ দুঃখ পেলো। বিষাদের জ্বালায় তার একজগ সাইট্রিক এসিড, ট্যানিক এসিড, সালফিউরিক এসিড আর অ্যাসিটিক এসিডে ডুব দিতে ইচ্ছে হলো। নিবিড় তুমি বিয়ে না করলে আমার কি হবে? আমি তোমাকে সব স্বাধীনতা দেবো প্রমিজ। আমাকে বিয়ে করো না!


#চলবে


إرسال تعليق

Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.