#ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
#পর্বঃ১০
#লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন
নোরিনের ঘরে ফেরার ঠিক দুদিন পরের কথা। সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ নিবিড় এসে হাজির। চোখের দৃষ্টি এলোমেলো, কপালের চুলগুলো অবহেলিত, উষ্কখুষ্ক।
নিবিড়কে হলরুমের সোফায় বসতে বলে বাড়ির কাজের লোক লাইলা নোরিনকে ডাকতে গেলো। দোতলায় নোরিন গুণগুণ করে পড়ছিলো তখন। গায়ের লাল টকটকে শাল জড়িয়ে, মাথায় একটা মানকি টুপি , লাল টকটকে ঠোঁট নাড়িয়ে বিড়বিড় করে পড়ছিলো। তার বাবা এখনো তাকে মানকি টুপি পরায়। কানে বাতাস ঢুকবে না। শীতকালে কখন ঠান্ডা লেগে যায় তার ঠিক নেই। তারউপর নোরিনের একবার সর্দি-কাশি হলে সহজে ছাড়তে চায়না। মাফলার কখন না কখন জায়গা থেকে সরে যায়! সুতরাং, মানকি টুপিই উত্তম। লাইলার মুখে কোন অপরিচিত ছেলে এসেছে শুনে, নোরিন মুখ নাড়ানো বন্ধ করলো। বাবা অফিসে। এই অসময়ে কে আসতে পারে? লাইলা এসেই তাকে বলতে লাগলো,
---- আফা, নিচে কোন বেডা আইছে জানি না। এমন সুন্দর কি কইতাম! সাদা একখান শার্ট পরছে, রাজপুত্তুরের মতোন লাগতাছে। এমন লম্বা, খালি চোখ উপরে তুলে কথা কওন লাগে। চুলগুলা মাইয়াগো মতো.......
----- কি সমস্যা লাইলা? এতো ডিটেইলস কে জানতে চেয়েছে। যেই হোক বলো বাবা বাড়িতে নেই। আমাকে যদি খুঁজে, আমিও নেই বলবে। তুমিও আমার সামনে আসবে তো দূরে থাক, দোতলার সিঁড়িতেও পা রাখবে না। আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত এবং বিরক্ত। চলে যাও.....
নোরিনের কথায় অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো লাইলার। হাতে থাকা ঘর মোছার কাপড়টা থপ করে পরে গেলো হাত থেকে। এমন ভাবে তো তার স্যারও বলে না। তার ইচ্ছে হলো, হাত পা ছড়িয়ে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদে। এই বাড়িতে তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে নোরিন আর সবচেয়ে বেশি ধমক দেয়ও নোরিন।
লাইলা চলে যাওয়ার পর নোরিন আবার মনোযোগী ভঙ্গিতে পড়তে শুরু করলো। বিয়ের ঝামেলায় একেবারেই পড়া হয়নি কয়েকদিন। পুরনো পড়া আর নতুন পড়া সবকিছু একসাথে কভার করতে হচ্ছে। মহা ঝামেলা!
হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হলো। লাইলাকে চলে যেতে বলেছিলাম। এতো সাহস, মানা করার পরও আসে! নোরিন অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। মুহূর্তেই হাতের বইটা মাটিতে পড়ে গেলো। হাঁটাহাটি থামিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। এটা কি স্বপ্ন নাকি বাস্তব? উনার তো এখন নানুবাড়িতে থাকার কথা। এটা উনি হতেই পারে না। নিশ্চয়ই হেলুসিনেশন হচ্ছে।
নোরিনের মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিলো। একি! হ্যালুসিনেশন তো এতোক্ষণ স্থায়ী থাকে না। উনি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন না কেন? তারমানে নিবিড় সত্যি সত্যি আমার বাড়িতে! আমার রুমে! না না, না এটা কি করে হয়! এটা নিবিড় হতেই পারে না।
নিবিড় এক কদম সামনে এগিয়ে আসতেই, নোরিন দু'কদম পিছিয়ে গেলো। পেছাতে পেছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। গলা শুঁকিয়ে গেছে। এক্ষুনি পানি খাওয়া দরকার। আমার চোখ ঘুরঘুর করছে, বুকে অসম্ভব রকমের ব্যাথা করছে। আমার মন বারবার আমাকে বিশ্বাস করাতে চাইছে, সামনে থাকা ব্যক্তিটা কোনোভাবেই নিবিড় হতে পারে না। উনি এখানে আসতেই পারেন না।
--- বুড়ি আমাকে সালাম কর!
নোরিন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ওমাই গড! নিবিড়ের ভূতটা তো কথাও বলছে দেখছি। নোরিন যেন নিজের মধ্যে নেই। তার দুনিয়া আবার লন্ডভন্ড হয়ে গেছে প্রতিবারের মতো। নিবিড় নামক অশান্ত ছেলেটা বারবার তাকে এলোমেলো করে দেয়।
নোরিন আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো নিবিড়ের সামনে।
---- নিবিড় ভাইয়া, আপনি আমাকে একটু ছুঁইয়ে দিনতো!
নিবিড় শুধু নোরিনকে ছুঁলেনই না, আস্তে করে নোরিনের ছোট ছোট চুলগুলো টেনেও ধরলেন।
---- সবসময় এতো ছেলে ছেলে ভাব কেনো? তুই কি ছেলে নাকি! ঘাড় অব্দি চুল নিয়ে, জিন্স-শার্ট পড়ে, ছেলেদের মতো মোড নিয়ে তুই কি বাই এনি চান্স নিজেকে ছেলে প্রমাণ করতে চাস? মেয়েদের এতো ভাব মানায় না।
নোরিন হতাশ হলো। সে এখন নিশ্চিত হয়েছে এটা আসলেই নিবিড়। নিবিড় ছাড়া কেউ হতেই পারে না! আসলেই চরম উন্মাদ এবং বজ্জাত ছেলে।
--- ভাইয়া আপনি কেনো এসেছেন?
--- কিছু দিতে এসেছি।
কিছু দিতে এসেছি মানে কি বুঝাতে চাইলেন নিবিড়? উনি কি সেই দুই লাইনের চিঠিটা হাতে পেয়েছেন? সেটাই কি দিতে এসেছেন? নোরিন বুক ব্যাথা আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলো। মুখে খেলে গেলো লজ্জার হাসি। এই মুহূর্তে ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারলে বেশ হতো। চারপাশে এতো লজ্জায় ভরপুর কেন?
--- কি জিনিস ভাইয়া?
নিবিড় নোরিনের আশায় এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে বললো,
--- তুই একটা শার্ট ফেলে এসেছিলি,সেটাই দিতে এসেছি। দেখ!
নিবিড় সত্যিই নোরিনের একটা শার্ট বের করে দেখালো, যেটা সে নানুবাড়িতে ফেলে এসেছিলো। রাগে নোরিনের মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। এতো মাইল পাড়ি দিয়ে, বৌভাতের অনুষ্ঠান ফেলে উনি শুধুমাত্র এই একটা শার্ট দিতে, এই ভর সন্ধ্যাবেলা এখানে এসেছেন? রাগে দুঃখে নোরিনের রীতিমতো কাঁদতে ইচ্ছে হলো। মানুষটা এতো খারাপ কেনো? তারমানে নিবিড় ঐ লিখাটা পড়েননি? এটা কী করে হয়! কাগজটা এমন জায়গায় সে রেখেছিলো যে, নিবিড় ব্যাগের চেইন খুললেই ওটা দেখতে পাবে।
---- তোদের বাড়ির সামনে একটা চমৎকার গার্ডেন দেখলাম। আমাকেও একটু ঘুরে দেখা!
ব্যাটা ভদ্র শয়তান! তোকে আমি গার্ডেনের "গ" তেও নিয়ে যেতে পারবো না। তোর সাথে আমি রাগ করেছি।
---- জ্বি ভাইয়া কেনো নয়! কেনো নয়! চলুন না!
নোরিন মুখে ম্যাকি হাসি ঝুলিয়ে নিবিড়কে নিয়ে দোতলায় বেয়ে নিচে নামলো। তারপর বাড়ির সামনে গার্ডেনে গেলো।
নিবিড় গার্ডেনের চেয়ারে বসে আশেপাশে তাকালো।
---- আবাসিক এলাকা, সরকারি বাংলো, বিরাট জায়গা নিয়ে বাউন্ডারি বাহ্! তোর বাবা তো দেখছি ভালোই কামায়। আসার সময় তো দারোয়ান ঢুকতেই দিচ্ছিলো না। পরে তোর সাথে একটা সেলফি দেখিয়ে, আত্মীয় টাত্মীয়, অনেক বলেকয়ে ভেতরে আসলাম৷ তোর কপাল তো সোনায় সোহাগা! দুবেলা বসবি, খাবি, ঘুমাবি আর বাপের টাকা উড়াবি।
নোরিন জবাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শুধু। নিজেকে আপ্রাণ শান্ত রাখতে চেষ্টা করলো। এই অসভ্যটার সামনে কিছুতেই নিজের ব্যক্তিত্বে আঘাত হানতে দেবে না নোরিন। পরে দেখা যাবে, এই অশান্ত ছেলেটা তাকে তার কথা দিয়েই নাচাচ্ছে। জাস্ট ইম্পসিবল!
নিবিড় চেয়ারের পেছনে হাত রেখে মাথা ঠেকিয়ে আরো আরাম করে বসলো। দৃষ্টি আকাশপানে। নোরিন শান্ত দৃষ্টিতে নিবিড়ের মতিগতি পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।
নিবিড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তাতে নোরিন যেন ভস্ম হয়ে গেলো! বুকটা মৃদু আওয়াজে ঢিপঢিপ করছে। মহাজ্বালা!
--- জানিস বুড়ি! আমি এক বন্ধু অনিক। আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম স্কুল লেভেল থেকে। সবাই বলতো, আমাদের দুজনের মধ্যে যদি কোনো একজন মেয়ে হতো, তাহলে আমাদের বিয়ে দিয়ে দিতো। এমন কোনো বিষয় ছিলো না, যা আমরা একজন আরেকজনের সাথে শেয়ার করিনি৷ যত রকম কষ্ট থাকুক না কেন অনিক আমার সাথে সব শেয়ার করতো৷ যেখানেই যেতাম ওকে সাথে নিয়ে যেতাম৷ আমার কথায় অনিক কখনো রাগ করতো না। যত অপমানই করি, পরদিন আমার দরজার সামনে এসে বলবে, " দোস্ত কেমন আছিস?" এভাবেই চলছিলো৷ একসময় আমি ডিইউ'তে টিকে গেলেও, অনিকের নাম আসলো না। একদিন ছুটি নিয়ে বাড়ি আসতেই খেয়াল করলাম, অনিক আর আগের মতো নেই। সেই প্রাণোচ্ছল ভাবটা আর নেই। আমাকে দেখলেই লুকাতে চাইতো। নিজেকে একরকম আড়ালে নিয়ে গেলো৷ আমি চেষ্টা করতাম, কিন্তু ও কিছুতেই জানাতে চায়নি।সেবার ছুটি শেষে আমি ক্যাম্পাসে ফিরে গেলাম৷ এর মাঝে একদিন শুনি অনিক আর নেই। মারা গেছে। বুড়ি তুই ভাবতে পারছিস? আমার বন্ধু আর নেই। হুট করে চলে গেলো আমাকে না জানিয়ে। আমি অনেক কিছু ম্যানেজ করে বাড়ি ফিরলাম। অনেকদিন পর জানতে পারি, অনিক একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। এতোটাই ভালোবাসতো যে, আমাকেও কোনোদিন জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি৷ মেয়েটা ওর ভালোবাসার মূল্য দেয়নি। ওকে ঠকিয়ে চলে গেলো। আর আমার বোকা অনিকটা অভিমান করে চলে গেলো। হ্যাঁ আসলেই অনিক বোকা ছিলো। নাহলে একটা মেয়ের জন্য জীবন দেয়! আরেকটা ঘটনা কি হলো জানিস? আমার ক্যাম্পাসের এক বড় ভাই। তুখোড় মেধাবী। ব্রাইট ফিউচার। বড় বড় চাকরিও তার কাছে কিছু নয়! সেই হাসিখুশি বড় ভাই একদিন হুট করে ত্রিশটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে বিছানায় পড়লো। ভাই এখন কি করে জানতে চাস? সে এখন একটা মানসিক হসপিটালের রোগী। কোথায় চাকরি! কোথায় ভবিষ্যতে! সব শেষ। তার কারণ হলো ঐযে সো কল্ড ভালোবাসা! একটা মেয়ে হাজারটা ছেলেকে ঠকিয়ে জাস্ট টাকার জন্য নিজের জ্বালে ফাসায়। আরো কত মেয়ে দেখলাম, সবাই একই! আরো এমন হাজারো ঘটনা আছে তুই কি শুনতে চাস নোরিন? বলবো? না থাক। জানিস নোরিন? মেয়েরা না চাইলে সব ঠিক করতে পারে৷ ওরা আসলে প্রত্যকেই বিশ্বাসঘাতক। ওরা ঠকবাজ, লোভী! আমি ঘৃণা করি তাদের। নোরিন তোকে আমি বোঝাতে পারবো না হাউ মাচ আই হেট দ্যাম!
নিবিড় টেবিলে একটা বারি মারলো। চোখ টকটকে লাল আকার ধারণ করেছে।
---- আমি কোনো বিশ্বাসঘাতককে আমার লাইফে আসতে দেবো না। আমি কাউকে সেই সুযোগ দেবো না। সব মেয়েই খারাপ! সবাই!
#চলবে