ওয়েবসাইট কাস্টমাইজেশন এর জন্য। Contact Us Welcome!

গল্প: ভালোবেসেছি তোরই মতো পর্বঃ ১৬

Bangla Dub Novels

 #ভালোবেসেছি_তোরই_মতো

#পর্বঃ১৬

লেখিকাঃ #শাদিয়া_চৌধুরী_নোন


সেনাবাহিনীর সার্কোলার ছাড়া হয়েছে। নোরিন দেরি না করে আবেদনপত্র জমা দিয়ে এসেছে আজমল সাহেবের সাহায্যে। 

যতই দিন এগিয়ে আসছিলো,  নোরিনের মনে সংশয়ের দানা বাসা বাঁধছিল। জীবনের এই প্রথম কোনো পরীক্ষার আগে, নিজেকে নিয়ে বারবার দ্বিধায় পড়তে হচ্ছিলো। এটা যে তার স্বপ্ন!  তার হাজার রাত নির্ঘুমের কারণ। যদি কোনো বাঁধা আসে? যদি কোনো কারণে বাদ পড়ে যায়?


একদিন লাঞ্চে বসে বাপবেটি খাবার খাচ্ছিলো।  আজমল আলী সেরনিয়াবাত শুধু একবার বললেন,

---- মামণি, প্রিপারেশন কেমন? তুমি কি প্রস্তুত? 


সামান্য এই কথায় নোরিনের হাত থেকে চামচ পড়ে গেলো। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো সে বাবার দিকে। আজমল সাহেব মেয়ের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেন, 

---- তুমি কি কোনো কারণে সংশয়ে ভুগছো? 


---- বাবা, আই ওয়ান্ট টু বি দ্যা বেস্ট ক্যাডেট। আ'ম রেডি। কিন্তু.... 


---- বুঝতে পেরেছি। মা একটা কথা জেনে রেখো, আমরা যে জিনিসটাকে খুব করে চাই, যাকে নিয়ে দূর থেকে হাজারো স্বপ্ন দেখি, সেই স্বপ্ন যদি একদিন আমাদের খুব কাছে চলে আসে;দরজায় কড়া নাড়ে তখন তুমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়বে। নিজেকে নিয়ে দ্বিধায় ভুগবে। মনে হবে, আমি কি এটার যোগ্য? স্বপ্নের কাছে নিজেকে ছোট মনে হবে। তখন তোমার কি উচিত? তোমার উচিত নিজের উপর আত্মবিশ্বাস রাখা। মনোবল না হারানো। আর অবশ্যই নিজের সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করা। কারণ তিনি যেমন উঁচুতে ওঠাতে পারেন , তার চেয়ে কম সময়ে নিচে নামাতে পারেন। আশা করি তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো। আই নো,  ইউ আর এ্যা গুড লিসেনার।  


নোরিন একটা বড় দম নিলো। বাবাকে আশ্বস্ত করে বললো,

---- ইয়েস বাবা, আই'ল বি দ্যা বেস্ট। ওয়ানডে দে উইল এনাউন্স দ্যাট,  দ্যা  সোর্ড অব অর্নার ব্যাচ ইজ গোজ ফর নোরিন আলী সেরনিয়াবাত।  কিপ এ্যা বিগ ক্লেপ ফর হার। 


আজমল সাহেব হো হো করে হাসলেন। এটাই তো চাই তাঁর। নোরিনের মুখে হাসিটাই তিনি চান। এই হাসির বিনিময়ে সবকিছু করতে রাজি। 

খাবার খেয়ে নোরিন তড়িঘড়ি করে প্রার্থনায় বসলো। নোরিন দু-হাত তুলে  বললো,

--- "আমি একাকিত্ব অনুভব করছি। " 


নোরিনের মনে হলো, কেউ যেন তার কানে কানে বলছে,

---- " আমি তোমার নিকটেই। " 


নোরিন প্রশান্তির হাসি নিয়ে বললো,

---- " আমাকে একা করে দিও না।  মুখ ফিরিয়ে নিও না কখনো।  " 


আবার কানে কানো কেউ বললো,

---- "আমাকে স্মরণ করো, আমি তোমাকে স্মরণ করবো।" 


নোরিন এবার ভাঙা মনে বললো,

---- "আমার জীবন অনেক সমস্যা দ্বারা আবৃত। কিছু কে আমি ভুলতে পারি না৷ কিছু মুহূর্ত আমাকে শান্তি দেয়না৷ আমার সম্মুখে-অন্তরালের কোনো কিছুই তোমার অজানা নয়। "


আবার উত্তর এলো,

--- "আমাকে ভয় করো। আমি একটি উপায় বের করে দেবো। "  [আল্ কুরআন]


----  শোকর আলহামদুলিল্লাহ। 


-------------------

নোরিন নিজের স্বপ্ন সিঁড়ির একটিতে উত্তীর্ণ হয়েছে।  তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্যের প্রথম ধাপ সে খুব সহজেই পার করে এসেছে। প্রিলিমিনারী পরীক্ষা এবং মৌখিক পরীক্ষায় খুব সহজেই উত্তীর্ণ হতে পেরেছে৷ মৌখিক পরীক্ষায় নোরিন নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে৷ একজন ক্যাপ্টেন তো নোরিনকে মুখের উপরই বলে দিলো, 

---- ওখানে এতো স্কিন কেয়ার করার সময় পাবে না৷ এখনো সময় আছে৷ অনেক খাটনি আছে। তুমি পারবে?


নোরিন শান্ত মুখে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি নিয়ে বললো, 

--- আমাকে নিয়ে চিন্তা করার জন্য ধন্যবাদ। জেনে বুঝে আগুনে ঝাপ দেয়না কেউ৷ বাঁচতে নয়, বাঁচাতে চাই। 


পরের প্রশ্ন ছিলো,

---- তুমি কেনো একজন আর্মি হতে চাও? 


---- আপনাদের মতো ঐ পোশাক পরে,  নিজের স্বার্থকতার স্বাদ নিতে৷ নিজেকে অনেক বেশি ভালোবাসি৷ সুতরাং নিজের স্বপ্নের দামও আমার কাছে অনেক বেশি। 


--- নিজেকে ভালোবাসলে তো জীবনের মায়াও আছে নিশ্চয়ই? তুমি মরবে না এর কোনো নিশ্চয়তা আছে?  একজন আর্মি অফিসার হয়ে তুমি কি আশা করবে? 


নোরিন তার অভিনব কৌশল খাটিয়ে বললো, 

--- আপনি যে আজীবন বেঁচে থাকবেন তার কোনো গ্যারান্টি আছে? আপনার কাছে একটা স্যালুট আশা করবো। তবে আজ নয়, যেদিন নিজের যোগ্যতাকে প্রমাণ করবো, সেদিন আপনার একটা স্যালুটের আশায় থাকবো আমি। দেহের মৃত্যু হলেও, মনের মৃত্যু কখনোই হয়না৷ সুতরাং মৃত্যুকে আমি ভয় পাবো না৷ আমি চ্যালেঞ্জ পছন্দ করি। 


নোরিনের কথা শোনে ক্যাপ্টেন হকচকিয়ে গেলো। কি অসীম মনোবল মেয়েটার! কি সাহস! এতোক্ষণ সব প্রার্থীর চোখে ভয় ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনি, চোখে চোখ রেখে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছিলো৷ কথা বলায় জড়তা আর এই মেয়েটা? এমন ভঙ্গিতে কথা বলছে যেন সে ভাইভা না, স্বাভাবিক বন্ধুদের সাথে কথা বলছে৷ কি দারুণ গাম্ভীর্য চোখে,  এতোটুকু বয়সে কি কঠিন কথা বলে ফেললো! ভয়ের লেশমাত্র নেই। খোঁচা মেরে আত্মবিশ্বাস যাচাই করতে গিয়ে, নিজেই ফেঁসে গেছে ক্যাপ্টিন৷ তিনি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারেন, সামনে বসে থাকা তরুণীকে একদিন স্যালুট করতে হতে পারে। করতে হয়তো বাধ্য হবেন তিনি৷ 


নোরিনের পরীক্ষার বহর এখনো শেষ হয়নি। বুয়েট, মেডিক্যাল বা অন্যান্য পরীক্ষায় হয়তো শুধু মেধা নির্বাচন করা হয় কিন্তু নোরিন যাকে ভবিষ্যতের জন্য বাছাই করেছে, সেখানে মেধা ছাড়াও বেশি প্রাধান্য পায় মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা, বুদ্ধিমত্তা, ব্যক্তিত্ব,বিচারবোধ, উপস্থিত বুদ্ধি, পরিকল্পনা ক্ষমতা,নেতৃত্ব এবং শারীরিক দক্ষতা।  নিজের দক্ষতা প্রমাণ করতে নোরিনের পরবর্তী ধাপ ছিলো ইন্টার সার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ড ( আইএসএসবি) এর চারদিন ব্যাপী পরীক্ষা।  চোখে এক সমুদ্র স্বপ্ন নিয়ে নোরিন এগিয়ে যেতে লাগলো। অদম্য উৎসাহ নিয়ে সে বাকি ধাপ গুলোও অতিক্রম করলো। চূড়ান্ত মেডিক্যাল এবং সাঁতার পরীক্ষার পর নোরিনের সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হলো। মনে হলো যেন, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ কোনো পরীক্ষা ছিলো না, এসব ছিলো তার একেকটা সিঁড়ি।  সামনে তার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।  আর কয়েকদিন পরই সে চলে যাবে চট্টগ্রামে।  যেখানে অবস্থিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমী। যেখানে, তরুণ ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়। যারা আগামী দিনে দেশকে রক্ষা করবে।  

নোরিনকে বিএমএ লং কোর্সের জন্য আগামী তিন বছর চট্টগ্রামে থাকতে হবে। আর কয়েকদিন পরই তার বাস। নোরিন তুমুল আগ্রহ নিয়ে সেখানকার জীবন কেমন হতে পারে তার পরিকল্পনা করছে, ব্যাগ প্যাক করছে, কলেজে গিয়ে টিচারদের দোয়া নিলো। সুযোগ করে একদিন নানুমণিকেও সালাম করে আসলো৷ দিনে গিয়ে, দিনেই চলে চলে এলো। আজমল সাহেব দূর থেকে হাজারো দীর্ঘশ্বাস ফেলেন৷ যে মেয়েকে কোনোদিন একা ছাড়েননি, একটা ফুলের আঁচড় লাগতে দেননি সেখানে তিনি কিভাবে পারবেন তিনটে বছর মেয়েকে ছাড়া থাকতে! এতো পেশা থাকতে বেছে নিয়েছে ওই মরণ পেশাকে। 

একসন্ধ্যায় ঝড়ো হাওয়া বয়ছিলো। নোরিন আর বারান্দার চেয়ারে বসে বাইরে তাকিয়ে। মনে মনে উসখুস করছে সে। আর বেশিদিন বাকি নেয়। আর কয়েকদিন পরেই চট্টগ্রাম চলে যেতে হবে। এমন সময় আজমল সাহেব এসে নোরিনের পাশে বসলো। চেয়ারে বসতেই তিনি অবুঝ বাচ্চার মতো অঝোরে কাঁদতে লাগলেন৷ নোরিনের সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকালো। 

---- বাবা কেঁদো না৷ তিনটে বছরই তো। আসবো ছুটি পেলে। 


আজমল সাহেব ফুপিয়ে বললেন,

--- সে-ই তো আবার চলে যাবি। 


নোরিন খানিকটা রাগ নিয়ে বললো,

---- কেঁদো না তো! আমার বিরক্তি লাগছে। 


আজমল সাহেব রুমাল বের করে চোখ মুছলেন।

---- মা রে, তুই ডাক্তার হতি, আমি তোকে বেস্ট মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করিয়ে দিতাম, তুই ইন্জিনিয়ার হতে পারতি কিংবা ভার্সিটি প্রফেসর কিন্তু তুই এটা কেনো বেছে নিলি মা? তোর এতো খাটতে হবে কেন?আমার এতো টাকা খাবে কে! সারাজীবনের এতো সঞ্চয় কার জন্য করলাম! তোর মা নেই, এখন তুইও থাকবি না। তুই সারাদিন রোদে রোদে দৌড়াবি, কসরত করবি, এক আধখানা রুটি খাবি আর এদিকে এসির নিচে বসে কীভাবে বিরিয়ানি খাবো বল? আমার কলিজা একমাত্র মেয়ে তুই৷ তুই ছাড়া আর কেউ নেই। আমি বাবা হয়ে তোকে এতো কষ্ট কীভাবে পেতে দিই? 


নোরিন বাবার কাঁধে হাত রেখে বললো,

--- বাবা তুমি প্র্যাকটিক্যালি কেনো চিন্তা করছো না? তুমি নিজেই দেখো, তুমি কিন্তু আমাকে আমার স্বপ্নের পথে বাঁধা দিচ্ছো। কোনো মেয়ে কি চাই বলো, তার বাবা তার স্বপ্নে বাঁধা দিক? মা কিন্তু জানলে খুব রাগ করবে। 

নোরিন এবার মোলায়েম কণ্ঠে বললো,

--- বাবা আমিও তোমাকে মিস করবো। খাবার টেবিলে একসাথে খাওয়াটা মিস করবো, দুজন মিলে একসাথে গালি দেওয়াটা মনে পড়বে ভীষণ, সকাল আর বিকেলে তোমাকে চা করে দেওয়া আর প্রেশারের ওষুধটা না দিতে পারার দুঃখে কাদঁতে ইচ্ছে করবে, দুজন মিলে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকা আর প্রতি ছুটিতে ঘুরতে যাওয়াটাও অনেক মিস করবো। তবে শুধু তিন বছরের জন্য৷ আমরা আবার একসাথে, এক বাড়িতে থাকবো বাবা। অনেকদিন! 


আজমল সাহেব নোরিনের কথা শুনে আবারো কেঁদে উঠলেন৷ এতো কঠোর কেনো হলো মেয়েটা? কার স্বভাব পেয়েছে? নোরিনের চোখও ছলছল করছে কিন্তু এক ফোঁটা পানিও গড়ালো না৷ আজমল সাহেব অভিমানি কণ্ঠে বললেন,

---- এতো কিছু জানিনা৷ তোকে আমি বিয়ে দিয়ে দেবো। কোনো পছন্দের ছেলে আছে কি-না বল। তারপর দুজনে মিলে তোকে ঘরে বেঁধে রাখবো৷ যেতে দেবো না৷ 


নোরিনের বুকে চিনচিন ব্যাথা শুরু হলো। আজ বহুদিন পর একজনের ছবি মানসপটে ভেসে উঠলো৷ খুব দ্রুত আবার ছবিটাকে মুছে ফেললো নোরিন৷ এই কাজটা সে খুব ভালো করে পারে সে। বাবাকে চমৎকার হাসি নিয়ে বললো,

---- বাবা আমিতো বিয়েই করবো না! বিয়ে করে কি হবে?


আজমল সাহেব মনে মনে বললেন, ' মেয়েটা এতো সুন্দর হাসি কোথা থেকে শিখলো? আমি কীভাবে পারবো টানা এতোগুলো দিন এই মিষ্টি চেহারা না দেখে থাকতে? আমার মা... ' 


--- ভালোবাসবি! বিয়ে করে তোরা দুজন দুজনকে ভালোবাসবি৷ জানিস মা? ভালোবাসা খুব মিষ্টি একটা অনুভূতি।  "ভালোবাসা" খুব ভারী একটা শব্দ।  এটাকে সংজ্ঞায়িত করা ভীষণ কঠিন। এটা জীবন্ত একটা অনুভূতি।  


নোরিন মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মনে মনে বললো,

--- ভালোবাসাটা যে বিয়ের চেয়ে জ্যন্ত। ভালোবাসলেই কি বলে বেড়াতে হবে? যে ভালোবাসা যত বেশি গোপন, সেই ভালোবাসার গভীরতা তত বেশি। আজ একটা কথার বড্ড মিল পাচ্ছি,  পৃথিবীতে বালিকার প্রথম প্রেমের মতো সর্বগ্রাসী প্রেম আর কিছুই নেই। প্রথম যৌবনে বালিকা যাকে ভালোবাসে, তার মতো সৌভাগ্যবানও কেউ নেই। যদিও সে প্রেম অধিকাংশ সময় অপ্রকাশিত থেকে যায় কিন্তু সেই প্রেমের আগুন বালিকাকে সারাজীবন পোড়ায়। বাবা, এখন সময় পেরিয়ে গেছে, আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও আমি তাকে গ্রহণ করবো না৷ ভালোবাসা প্রকাশিত হলে তার দাম কমে যায়। আমি নোরিন আলী সেরনিয়াবাত এখন নিজেকে ভালোবাসি, নিজের মূল্য অনেক বেশি আমার কাছে। 


#চলবে

إرسال تعليق

Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.